আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর আঘাত হানার খবরে সাতক্ষীরাসহ গোটা উপকূলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
মাত্র এক বছর আগে ঘটে যাওয়া আম্পানের ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আবারও একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আগমনি বার্তায় স্থানীয়দের মধ্যে রীতিমত ভীতিকর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। ‘আম্পানের’ ক্ষত কাটিয়ে এখনো বসত ভিটায় ফিরতে পারিনি অনেকে। নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি আম্পানে ক্ষতিগ্রস্থ ভেড়িবাঁধ। এরই মধ্যে আবারও বড় একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’এর সম্মুখীন হতে হচ্ছে সাতক্ষীরাসহ খুলনা অঞ্চলের মানুষকে। বিশেষ করে টেকসইভাবে সংস্কারের অভাবে থাকা জীর্ণশীর্ণ উপকূল রক্ষা বাঁধের করুন অবস্থা উপকূলবাসীকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। এছাড়া ব্যবহার উপযোগী পানীয় জলের তীব্র্র সংকটের পাশাপাশি আম্পানের আঘাতে বিধ্বস্থ ঘরবাড়ি এখনও পরিপূর্ণভাবে মেরামত করতে না পারায় চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন তারা। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছে। আগামী দু’এক দিনের মধ্যে যেকোনো সময় ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে- সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের অন্তত ৪৮২ কিলোমিটার বাঁধ।
স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড় আইলা,সিডর,বুলবুল ও আম্পান যখন এসে ছিল তখন নদীতে ভরা জোয়ার। এবারও ঠিক তাই। ভরা পূর্ণিমার কারণে এবাও স্বাভাবিকের তুলনায় নদ-নদীতে জোয়ারের পানি ৩-৪ ফুট বৃদ্ধিতে প্রবল আশঙ্কা থাকায় তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছে। তাই ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর আঘাতের আগাম খবরে গোটা উপকূলজুড়ে এক ভয়ার্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সবাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয় যাওয়ার বিষয়ে পুর্ব প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে অধিক জোয়ারের চাপে বাঁধ ভেঙে বা ছাপিয়ে সাগরের পানিতে সমগ্র এলাকা প্লাবিত হওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশী শংকায় রয়েছেন বলেও জানান।
গত দুই দিনে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুরসহ কৈখালী এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এমন ধারণা মিলেছে। স্থানীয়রা জানায় ‘বুলবুল’ ও আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া উপকূল রক্ষা বাঁধের বেশিরভাগ অংশ মজবুতভাবে বাঁধা হয়নি। অনেকাংশের বাঁধে যেমন টেকসইভাবে মেরামত করা হয়নি, আবার গোটা উপকূল রক্ষা বাঁধের উপরিভাগে আজ পর্যন্ত কোন মাটির কাজ হয়নি। এমতাবস্থায় ঘূর্ণিঝড় ‘যস’ যদি আবারও সুন্দরবন সংলগ্ন এ উপকূলীয় জনপদে আঘাত হানে তবে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শংকা রয়েছে।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ মোকাবিলায় সাতক্ষীরা জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আসন্ন ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। দুর্যোগের আগে, দুর্যোগের সময় এবং দুর্যোগের পরবর্তী করণীয় নিয়েও উপকূল বাসীকে সতর্ককরা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘সাতক্ষীরা জেলায় ১৪৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র আছে। এছাড়া আমাদের এক হাজার ৫০০ স্কুল-কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ১৮৩ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। দুই কোটি ১৫ লাখ টাকার নগদ অর্থ সহায়তার জন্য রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ওয়াটার ট্যাংকি রয়েছে। পুলিশ আনসার বিজিবি ও স্বাস্থ্য বিভাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের আনিচুর রহমান জানায়, আম্পানের পর একটা বছর কেটে গেলেও গাবুরাকে ঘিরে থাকা বাঁধের উপর মাটি দিয়ে উঁচু করার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ভাঙনমুখে থাকা অনেক জায়গার বাঁধ এখনও সরু আইলে পরিণত হয়েই আছে। এমন অবস্থায় পূর্ণিমার ভরা গোনে যদি ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আছড়ে পড়ে তবে আমাগো সাগরে ভেসে যাতি হবে।‘সবার যা হবে, আমারগোও তা মেনে নিতি হবে’- উল্লেখ করে চকবারা গ্রামর মুর্শিদা খাতুন বলেন, ‘মাত্র দশ দিন আগে স্বামীকে বাঘে খেয়েছে। ছেলে মেয়েগো মুখে খাবার দিতি পারতিছি নে। এই দু:সময়ে কোন জাগায় গে আশ্রয় নেবো ভেবে পাচ্ছিনে’।
এমন শংকায় ভরা অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালীনি , কৈখালীসহ উপকূলীয় জনপদে বসবাসরত হাজারও মানুষের মধ্যে কাজ করছে অভিন্ন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। তারা জানায়, ভঙ্গর বাঁধের দুরাবস্থা আর কর্মসংস্থানসহ পানীয় জলের তীব্র অভাবে প্রতিনিয়ত তারা জীবনের সাথে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
সুন্দরবন এলাকার গোলাখালী আকিরুন বেগম বলেন, ‘তিন পাশে নদী আর এক পাশে বনকে আশ্রয় করে আমাগো বাস। আম্পানের আঘাতে বাঁধ ভেঙে সমগ্র এলাকা এলো হয়ে গেলো’। ‘তিন/চার দিন আগে স্থানীয়রা বাঁধের ভাঙন কবলিত অংশ বেঁেধছে’-উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবারের ঘূর্ণিঝড় ভরা জোয়ারের সময় আঘাত করলে সাগরের সাথে মিশে যাতি হবে’। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখে বাড়িঘর ফেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া ছাড়া পথ থাকবে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা ডিভিশন-১ এর (শ্যামনগর অংশ) দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, আম্পানের আঘাতের পর ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা প্রায় ১৮০ কিলোমটিার বাঁধ এর কোথাও আপাতত নদী ভাঙনের সমস্যা নেই। তবে অতিরিক্ত জোয়ারের পানি যেন ছাপিয়ে বাঁধের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য একাধিক টিম দুর্বলতা খুঁজে বের করে সমাধানে কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছে ২৬ মে এর আগেই গোটা শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা বাঁধের দুর্বল স্থানে কাজ সম্পন্ন করে সাম্ভব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দেয়া যাবে।
উল্লেখ্য, বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে আগামী ২৬ তারিখ সন্ধ্যার দিকে ভারত-বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা অতিক্রমের বার্তা দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে উপকূলীয় জনপদে কর্মরত পাউবো, বিদ্যুৎ ও সিপিপি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবায় যুক্ত সকলকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকতে বলা হয়েছে।