ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে সাতক্ষীরায় ৪৯ পয়েন্টে ভাঙ্গন: সুন্দরবনে ১৭টি মিষ্টি পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্থ(ভিডিও)

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে সাতক্ষীরার চার উপজেলার ৪৯টি স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ভেঙে শতাধিক গ্রাম ও সহ¯্রাধিক চিংড়ি ঘের প্লাবিত হয়েছে। ফলে, ইতোমধ্যে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এবং অনেক স্থানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ থেকে বুড়িগোয়ালিনী পাঁচ কিলোমিটার ও হরিনগর থেকে চুনকুড়ি পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় পানি উন্নয়নের বোর্ডের বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে অসংখ্য চিংড়ি ঘের ও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে।
কলবাড়ি এলাকার আকবর আলী বলেন, ‘আম্পানের পর প্রায় এক বছর গৃহহীন ছিলাম। মাত্র দুই মাস আগে বাড়ি ফিরেছি। আবার একই অবস্থা।’
দাতিনাখালি গ্রামের আব্বাস গাজী বলেন, ‘এ যাত্রায় রক্ষা পেলে অন্য কোথাও চলে যাব। এত দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকা যায় না, বছর বছর গৃহহীন হয়ে সহায় সম্বল হারাতে হয়।’মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের নারী সদস্য সেলিনা সাঈদ বলেছেন, ‘চুনকুড়ি এলাকায় হৃদয় মন্ডল, সুবল মন্ডল, বিশ্বনাথ মন্ডল, বিমল মন্ডল, হানিফ গাজী, মাদেকা ফকির, রনজিৎ মন্ডল, হরিদাস মন্ডল, জগন্নাথ মন্ডলসহ ৫০টি পরিবারের কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে।’ইয়াসের প্রভাবে শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব উপজেলায় ১৫টি স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ভেঙে গেছে এবং ৩৬টি বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এতে প্রায় সাত শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের তিন নম্বর এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ভেঙে গেছে। এছাড়া গাড়রামারি, চাঁদনিমুখো, জেলেখালি ও নাপিতখালি এলাকায় বাঁধ উপচে চিংড়ি ঘেরে পানি ঢুকছে। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী, দাতিনাখালি, পশ্চিম দুর্গাবাটি এলাকায় বাঁধ ভেঙেছে। এছাড়া, কলবাড়ি, নীলডুমুর ও দাতিনাখালি এলাকায় বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের পাঁচ স্থান ভেঙে ও পাঁচ স্থান দিয়ে বাঁধ উপচে পানি ঢুকে গ্রাম প্লাবিত করেছে। কৈখালী ইউনিয়নের পাঁচটি স্থান দিয়ে বাঁধ উপচে ও একটি স্থানে ভেঙে পানি গ্রামের মধ্যে ঢুকে ঘরবাড়ি প্লাবিত করেছে। রমজাননগর ইউনিয়নের বাঁধের পাঁচটি স্থান উপচে ও দুইটি স্থান ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কাশিমারী ইউনিয়নে একটি স্থানে, আটুলিয়ার একটি স্থানে ও নূরনগর ইউনিয়নে দুইটি স্থান দিয়ে বাঁধ উপচে পানি প্রবাহিত হয়ে অসংখ্য ঘরবাড়ি প্লাবিত করেছে।
সাবেক ছাত্রনেতা রুহুল আমিন জানান, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ভেঙে গাবুরা ইউনিয়নে সাগরের পানি জোয়ার ভাটায় খেলছে। শত শত মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নে কুড়িকাউনিয়া ভেঙে এবং চালকা ও শুভ্রকাটির বাঁধ উপচে ভাতশালা, চর রহিমপুর, বসন্তপুর নাঙ্গলা বাঁধের ওপর দিয়ে পানি উপচে চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে।কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা ইউনিয়নের পূর্ব নারায়ণপুর, কুশলিয়া ইউনিয়নের বাজার গ্রাম, উপজেলা সদর, ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাঁশঝাড়িয়া, মুথরেশপুর ইউনিয়নের হাড়তদাহ কাঁকশিয়ালী নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকেছে। পূর্ব নারায়ণপুর গ্রামের দুই শতাধিক বাড়িতে পানি ঢুকে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।কালিগঞ্জ বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কালিগঞ্জের বাণিজ্যিক এলাকা নাজিমগঞ্জে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। অবিলম্বে ক্ষতি পূরণের দাবি জানানো হয়েছে সংশ্লিষ্টদের প্রতি।সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, ‘শ্যামনগর উপজেলায় আমাদের আওতায় ১২৫ কিলোমিটার বাঁধ আছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে সাত থেকে আট ফুট বেড়েছে। এর মধ্যে দুর্গাবাটি, গাগড়ামারি এই দুই স্থানে ও শুভ্রকাটির চার স্থানে ভেঙে ও সাত স্থানের বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে এবং চিংড়ি ঘেরে ঢুকছে।’পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আওতায় আশাশুনি এলাকায় ৮০ কিলোমিটার বাঁধ আছে। এর মধ্যে একটি স্থান ভেঙে ও সাতটি স্থানে পানি উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে।’
শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউল হক জানান, শ্যামনগরের ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টি ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ৪৯টি স্থান ভেঙে অথবা পানি উপচে লোকালয় পানি ঢুকছে। ইতোমধ্যে অনেক পরিবারের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। চিংড়ি ও কাঁকড়া ঘের ভেসে গেছে।’
শ্যামনগর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তুষার কান্তি মজুমদার জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় বিভিন্ন নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৭/৮ ফুট বৃদ্ধি পায়। এতে উপকূল রক্ষিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেঁড়িবাধ ভেঙে ও উপচিয়ে লোনা পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এ সমেয় ১২ টি ইউনিয়নের বিশেষ করে উপকূলীয় গাবুর, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালী ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে আড়াই হাজার মৎস্য ঘের সম্পূর্ণ তলিয়ে একাকার হয়ে যায়। এতে ৫ কোটি টাকার চিংড়ী সহ বিভিন্ন প্রজাতির সাদা মাছ পানিতে ভেসে যায়।
অপরদিকে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) শাহিনুর ইসলাম জানান, ঝড়ো হাওয়ায় ১২টি ইউনিয়নে ৪ হাজার ৮ শত কাঁচা ও আধা পাকা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তার মধ্যে ২৬৫টি কাচা ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধস্থ হয় এবং ৪হাজার ৫শত কাচা ও আধা পাকা ঘরবাড়ি আংশিক বিধস্থ হয়। ৫০ হাজার ৮শত মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।সাতক্ষীরা সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম এ হাসান বলেন, সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতায় ৫টি বন ষ্টেশন অফিস ও ১২টি টহল ফাড়িতে নির্মিত মিষ্টি পানির পুকুর লোনা পানিতে তলিয়ে একাকার হয়ে গেছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আ ন ম আবুজার গিফারী বলেন, ১২টি ইউনিয়ন ব্যাপি নগদ আড়াই লক্ষ টাকা এবং ১ মেট্রিক টন চাউল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সরকারী সাহায্যে অব্যাহত থাকবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে নয়, তার প্রভাবে সাতক্ষীরার নদ-নদীতে জোয়ারের পানি বেড়ে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে গৃহহীন মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে মাইকিং ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

https://youtu.be/NUl0YMylHdw

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।