একটি গাছ কাটার আগে তিনটি গাছ রোপণ করি; তার মধ্যে একটি ফলদ, একটি ঔষধি ও একটি বনজ। এ সেøাগানে সমাজের সব স্তরের মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করা দরকার। জনসংখ্যার চাপে বসতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানির প্রয়োজন মেটাতে আয়তনে ক্ষুদ্র এ বাংলাদেশের বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে ক্রমেই, সংকোচিত হয়ে আসছে বনভূমির পরিমাণ। সরকারি বেসরকারি হিসেবে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৬ বা ১০ শতাংশ মাত্র বন। অথচ প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে একটা দেশে বনভূমির প্রয়োজন আয়তনের ২৫শতাংশ। এখন দেশে অভাব দেখা দিচ্ছে কাঠ, বাঁশ, ফল-মূল এবং ওষুধপত্র তৈরির প্রয়োজনীয় বনজ দ্রব্যাদির। এভাবে আর কয়েক বছর চলতে থাকলে দেশে বনভূমির পরিমাণ শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে যার পরিণাম হবে ভয়াবহ। মানুষসহ প্রাণিকুল বেঁচে থাকবে না, দেখা দিবে বিপর্যয়, বিধ্বস্ত হবে সভ্যতা, বিপন্ন হবে দেশ ও জাতির অস্তিত্ব।
হাদিসে রাসুল সা. বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়াহ বা ধারাবাহিক পুণ্যের আমল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। মুসয়াব বিন আনাস রা. বলেন, রাসুল স. এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়-জুলুম না করে কিছু নির্মাণ করল অথবা কোনো চারা রোপণ করল, যতদিন পর্যন্ত আল্লাহর সৃষ্টি তা থেকে উপকৃত হবে, ততদিন পর্যন্ত রোপণকারী সওয়াব পেতে থাকবে।’
বৃক্ষ মহান সৃষ্টিকর্তার অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি। সবুজ পাতায় ছেয়ে থাকা বৃক্ষ প্রাণে জাগায় শিহরণ। হিমেল বাতাসে হৃদয় জুড়িয়ে আসে। কাঠফাটা রৌদ্রে ঘেমে যাওয়া শরীরের শান্তি আনে। বৃক্ষ ধু-ধু বালুচরে মুসাফির-পথিকের বন্ধু। রাখালের প্রশান্তির ঠিকানা। মানুষের জীবনের সঙ্গে বৃক্ষের প্রভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রত্যেক প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য গাছ আবশ্যকীয়। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। সেই অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। চারদিক সতেজ-সজীব গতিময় রাখে। বৃষ্টি ও পানি দ্বারা বৃক্ষ বেঁচে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের কাছে ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান। তখন তারা আনন্দিত হয়। (সুরা রূম, আয়াত : ৪৮)
মহান আল্লাহকে বৃক্ষরাজি সেজদা করে। তার তাসবিহ পাঠ করে। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আপনি কি দেখেননি নভোম-লে ও ভূম-লে যা কিছু আছে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বতমালা বৃক্ষলতা ও জীবজন্তু এবং অনেক মানুষ আল্লাহকে সেজদা করে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ১৮) রাসুল সা. নিজ হাতে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করেছেন। ইসলামে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষরোপণকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বৃক্ষরোপণে মহানবী (সা.) মানুষকে উৎসাহিত করেছেন বহুবার। জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির জন্য ইসলাম মানুষকে যেসব কর্মের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে তার অন্যতম কৃষিকাজ। কারণ, ভূমি উর্বর থাকলে ফলন ভালো হয়। পরিবেশ ভালো থাকে। মানুষ সহজে ব্যধিগ্রস্ত হয় না।
বৃক্ষরোপণে প্রিয় নবীর সা.-এর উৎসাহ প্রদান : রাসুল (সা.) কৃষিকাজ ও বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করেছেন। যাতে উদ্ভিদ বৃদ্ধি পায় ও সুস্থ পরিবেশ রক্ষা পায়। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো মুসলিম কোনো গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে। আর তা থেকে কোনো পোকামাকড় কিংবা মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩২০; মুসলিম, হাদিস : ৪০৫৫) হাদিসে বৃক্ষরোপণে প্রেরণা দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে একজন বান্দা তার মালিকের কাছ থেকে যথার্থ মূল্যায়ন পান। বান্দার লালন-পালনে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ থেকে সৃষ্টি জীবের কেউ কিছু খেলেই বা একটু উপকৃত হলেই সওয়াব লেখা হচ্ছে তার আমলনামায়। ব্যক্তি মরে গেলেও তা যুক্ত হবে সদকা জারিয়া হিসেবে।
ইসলাম বিভিন্নভাবে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করেছে। বৃক্ষরোপণ করতে গিয়ে যদি কোনো ফল প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার যথোপযুক্ত প্রাপ্তি বান্দাকে দেওয়া হবে। রাসুল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষরোপণ করে আর ফলদার হওয়া নাগাদ তার দেখাশোনা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফলের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে সদকার সওয়াব দেবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৬৭০২; শুআবুল ইমান, হাদিস : ৩২২৩)
বিনা প্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন নিষিদ্ধ : বৃক্ষ পরিবেশ শান্ত, ঠা-া ও মনোমুগ্ধকর রাখে। অপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করাকে কঠোরভাবে বারণ করেছেন আমাদের নবী সা.। আবদুল্লাহ ইবনে হুবশি রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে হুঁশিয়ারি দিয়ে রাসুল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৪১) তবে গাছ যদি এমন স্থানে হয় যার ফলে মানুষের চলাচল কষ্টকর হয়। পরিবেশ ও ঘরদোরের জন্য ক্ষতিকর হয় এবং মানুষের প্রয়োজনে কাটার প্রয়োজন হয়Ñ তাহলে গাছ কাটতে কোনো অসুবিধা নেই। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সা. বলেন, ‘আমি এক ব্যক্তিকে দেখেছি জান্নাতে সে ওই গাছের ছায়ায় চলাচল করছে, যা সে রাস্তার মোড় থেকে কেটেছিল, যা মানুষকে কষ্ট দিত।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৮৩৭)
বৃক্ষরোপণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী সা.-এর বিশেষ আমল। তিনি নিজে বৃক্ষরোপণ ও তার পরিচর্যা করতে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। পরিবেশ বাঁচাতে ও সুন্দর করে গড়ে তুলতে হলে বৃক্ষরোপণ বাড়াতে হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমরা এদিকে খুব কমই দৃষ্টি দেই। বনভূমি ধ্বংসের বিপরীতে বনাঞ্চল সৃষ্টির প্রয়াসে যেটুকু করা প্রয়োজন আমরা তা করছি না, প্রয়োজনীয় উৎসাহ-উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমাদের দেশে এপ্রিল-মে মাস হতেই বৃষ্টিপাত শুরুহয়। তাই এ সময় হতেই যত বড় আকারে সম্ভব গাছের চারা রোপণ করা উচিত। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে না দিয়ে পহেলা মে থেকে সারা বর্ষাকাল বৃক্ষ রোপণ মৌসুম হিসেবে গণ্য করে এ সময়ে বৃক্ষচারা রোপণ করতে হবে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা-মসজিদসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, বসতবাড়ি, রাস্তার পাশে, নদীর তীরে, বেড়িবাঁধে, উপকূল বেষ্টনীতে বাধ্যতামূলকভাবে ফলদ, ঔষধি ও বনজ গাছের চারা রোপণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণকৃত এসব গাছের চারা দেখাশোনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মহলসমূহের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বৃক্ষরোপণ একদিকে সামাজিক কার্যক্রম ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সবুজ বনায়ন সৃষ্টিতে সহায়তা করে অন্যদিকে মহান ¯্রষ্টার সৃষ্টির কল্যাণে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে। কেননা, বৃক্ষরোপণ একটি ইবাদত, সদকায়ে জারিয়াহ বা প্রবাহিত দান। যা আপনার আমার মৃত্যুর পরও জারি থাকবে। ইন-শা-আল্লাহ।
বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।