খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার ন্যায় শিক্ষাও মানুষের মৌলিক অধিকার। বিশেষত: প্রাথমিক শিক্ষা। বাংলাদেশের সংবিধানে এই মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি আছে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি গৃহীত হলেও প্রাথমিক শিক্ষা সার্বজনীন ও মৌলিক অধিকার হিসেবে এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ দেশে এখনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে সরকারি অনুদানে বা দেশি-বিদেশি এনজিও পরিচালিত স্কুল মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ন্যায় উপবৃত্তি পায় না। পায় না আরও নানা সুবিধা। তারা একই দেশের নাগরিক হওয়া স্বত্ত্বেও বঞ্চিত থাকে প্রাথমিক শিক্ষার এই মৌলিক অধিকারগুলো থেকে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা প্রণীত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন’ ১৯৮৩ সালের মধ্যে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯১৮ সালের মধ্যে দেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। তাতে আরও বলা হয়, ‘প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের।’
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বাংলাদেশী স্বতঃসিদ্ধভাবে কতিপয় মৌলিক অধিকারের মালিক। সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’-এর শুরুতেই এর ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক বাংলাদেশীর মৌলিক অধিকার ১৮টি।
সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ২৮নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। সুতরাং, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ি দেশের সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশের আলিয়া মাদরাসার সরকার স্বীকৃত এমপিওভুক্ত সংযুক্ত ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) মাদরাসা, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সরকারের দেয়া বিনামূল্যের বই পাচ্ছে বছরের শুরুতে। শিক্ষকগণ প্রতি মাসে বেতন-ভাতদি পাচ্ছেন, কিন্তু শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার ফলে প্রতি বছর শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। একইভাবে দেশের ব্র্যাক, আনন্দ নিকেতনসহ এনজিও পরিচালিত স্কুল ও কওমি মাদরাসার প্রাথমিক স্তরে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সরকারি উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা যায়, কোভিড ১৯ পূর্ববর্তী সময়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পঁচাত্তর টাকা (প্রতি মাসে) এবং প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিমাসে একশত টাকা করে দেয়া হতো। যা সাধারণত: প্রতি তিন মাস অন্তর শিক্ষার্থীর মায়ের বা উপযুক্ত অভিভাবকের মোবাইল (বিকাশ) একাউন্টে দেয়া হতো। করোনা অতিমারিতে গত বছর (২০২০) কোনো শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় এবং অটো প্রমোশন পেয়ে পরবর্তী ক্লাসে উন্নীত হওয়ার ফলে এখন সকল শিক্ষার্থী-ই উপবৃত্তি পাচ্ছে। যা প্রতি তিন মাস অন্তর তাদের নগদ একাউন্টে জামা হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় উৎসাহি করণের এমন কৃতির জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একই দেশের নাগরিক এবং একই পাঠ্য-পুস্তক প্রাপ্ত হয়ে পড়ালেখা করা স্বত্ত্বেও মাদরাসার ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) স্তরের শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি হতে বঞ্চিত।
শিক্ষা একটি মৌলিক ও মানবিক অধিকার। শিক্ষাব্যবস্থার কতগুলি মূলনীতি হল, প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্র অবশ্যই অবৈতনিক হবে এবং বাধ্যতামূলক হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা সাধারণ ভাবে লভ্য হবে এবং উচ্চশিক্ষা মেধানুসারে প্রত্যেকের কাছে গ্রহণীয় হবে। ইউনেস্কো ২০০০ সালে সবার জন্য শিক্ষা আন্দোলনটির সূচনা করে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৬তম পরিচ্ছেদ অনুযায়ী সমস্ত মানুষের শিক্ষার অধিকার আছে। এই শিক্ষা (ন্যূনতমপক্ষে প্রাথমিক স্তরে) বিনামূল্যের হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হতে হবে।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের অধিকাংশ বিষয়ের মতো শিশুর শিক্ষার বিষয়টিও উপেক্ষিত থেকে গেছে। বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি হলেও অনেক শিশু পড়ালেখা শেষ করছে না, প্রতিবছর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ এবং শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশুকে তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদনের সর্বোত্তম ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে তাদেরকে রক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা থাকলেও বৈষম্য যেনো পিছু ছাড়ছে না।
লেখক : বিলাল মাহিনী, পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণ-গ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র,
জীবন সদস্য : নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট, অভয়নগর, যশোর।