উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দরকার: টেকসই বেড়ি বাঁধ না হলে প্রতিবছর ৩০ হাজার মানুষ হবে উদ্বাস্ত:বাজেটে ‘উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড’ গঠনের দাবী: বাজেট বাস্তবায়নে দরকার মনিটরিং সেল:
আবু সাইদ বিশ্বাস: ক্রাইমবাতা রিপোট: উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও টেকসই বেড়ি বাঁধের লক্ষে চলতি বাজেটে পর্যান্ত বরাদ্দ না থাকায় হতাশ হয়েছে উপকূলের কয়েক কোটি মানুষ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলে হাজার হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বহু ঘরবাড়ি। অথচ অদৃশ্য কোনো কারণে এ নিয়ে কারও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। ঘরবাড়ি হারানো এ মানুষগুলো কোথায় থাকছে, কী খাচ্ছে, কীভাবে দিন কাটাচ্ছে সেই খবরাখবর রাখা যেন কারও দায়িত্ব নয়! এ দায়িত্বহীনতা এড়াতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে। দেশের শতকরা ২৫ ভাগ জনগণ যেমন এই উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ অবদানও এই অঞ্চলেরই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চল, এখানকার অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানান দৈব-দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার।
সূত্রমতে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার, এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্র সৈকত ৩১০ কিলোমিটার। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তনদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা। দেশের প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা, বিশ্বের সেরা গহিন গরান বন সুন্দরবন এবং বিশ্বের দীর্ঘতম অখন্ডিত (আনব্রোকেন) সমুদ্র সৈকত বা বেলাভূমি কক্সবাজার অবস্থিত।
১৭৯৭ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের আইলা পর্যন্ত সময়ের শুমার পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে মোট ৪৭৮ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, নার্গিসেরা বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পর পর। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছুটা আগে থেকে বিগত ৬১ বছরে ১৮৪টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে ঘন ঘন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সিডর আর আইলার আঘাতে সুন্দরবনও পর্যুদস্থ হয়। এর পর মাহাসেন, নার্গিস, ফণী, বুলবুল, আম্পান এবং এই সেদিন ইয়াসও কম ক্ষতির কারণ হয়নি।
খুলনা-সাতক্ষীরা-বাগেরহাট সহ এই বেল্টের উপকূলীয় অঞ্চল এখনও সিডর, আইলার ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এরমধ্যেই কয়েকদফা ঘূর্ণিঝড় এসব জেলাগুলোর জন্য যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। করোনার আগে হয়তো প্রতিবছরই কোনো না কোনভাবে দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারতেন এ অঞ্চলের মানুষ। তবে এখন করোনার আঘাতে সেটাও আর সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও টেকসই সমাধান না করে দেশ সামগ্রিক বিবেচনায় কোনভাবেই এগিয়ে যেতে পারবে না। এজন্য উপকূলের ক্ষতিগ্রস্থ বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষয়ক্ষতি ও জীবনমানকে প্রাধান্য দিয়ে টেকসই সমাধানের জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতেই হবে।
আগামী অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো খাতে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে উপকূলের ক্ষতিগ্রস্থ বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনমানকে প্রাধান্য দিয়ে টেকসই সমাধানের জন্য কত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি।
দুর্যোগ এলেই সংবাদমাধ্যমে দৃষ্টিগোচর হয় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকার সংবাদ। এরপর দুর্যোগ কেটে গেলে আর সেই বেড়িবাঁধের খবর থাকে না। খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে সেসব বাঁধ জীবনের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ স্বে”াশ্রমে গড়ে তোলে। সরকারও হয়তোবা বাজেট দেয়। কিন্তু সেই বাজেট কাগজে কলমেই থেকে যায়। নাহলে প্রতিবছর উপকূলের মানুষ বেড়িবাঁধ নিয়ে দুর্ভোগ পোহাবে কেন? এবার যেহেতু এখনও উপকূলীয় জনগণ ইয়াস সংকটের মধ্যে রয়েছে, সেজন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য বাজেট বরাদ্দ এবং সেই বরাদ্দ যেন যথাযথভাবে ব্যয় হয় সেজন্য মনিটরিং সেল গঠন করার দাবী উঠেছে।
সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকাকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ঘোষণা, পৃথক উপকূলীয় বোর্ড গঠন এবং জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ ২১ দফা দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি। চলতি সপ্তাহে সাতক্ষীরা ডিসি অফিসসংলগ্ন সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে জেলার সর্বস্তরের মানুষ। বক্তারা বলেন, সরকার নয় বছরে বেড়িবাঁধ সংস্কারে ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাঁধা হয়নি উপকূলীয় বাঁধ। সাতক্ষীরার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কারে সরকার শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। অথচ পানি উন্নয়ন বোপর্ডের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে সেই বাঁধ সংস্কার করা হয়নি। যে কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে বাড়িঘর ও সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে দক্ষিণ জনপদের কয়েক লাখ মানুষ। শুধু তাই নয়, স্থানীয় জনগণ স্বে”শ্রমে বাঁধ সংস্কার করে আর বিল তুলে নেয় সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। বক্তরা আরো বলেন প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ উদ্বাস্ত হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ত্রাণের নামে চলে চরম দুর্নীতি। কখনো কখনো ত্রাণের যে তালিকা করা হয় তার চেয়েও কম মানুষ ওই এলাকায় বসবাস করে।
সূত্র বলছে দেশের অন্যতম দুটি সামুদ্রিক বন্দর, প্রাকৃতিক সম্পদের স্বর্গ সুন্দরবন এবং পর্যটন সম্ভাবনা সমৃদ্ধ কক্সবাজারকে কার্যকর অবস্থায় পাওয়া জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভিযাত্রার জন্য যে কত জরুরি তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।এমতাবস্থায়, উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিঅর্থনীতি ও বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের সুরক্ষা নিয়ে ভবিষ্যবাদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্র্রিক সমুদ্রঅর্থনীতি বা ‘নীল অর্থনীতি’ বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন বিশেষ পরিকল্পনা। এসব লক্ষ্য পূরণে জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ একটি ‘উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করে বিশদ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …