সাতক্ষীরায় লাগামহীন ভাবে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা: নমুনা পরীক্ষার অভাবে সঠিক সংখ্যা জানা যাচ্ছেনা

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরায় লাগামহীন ভাবে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। পরীক্ষায় অনীহা ও হাসপাতালে সমক্ষতার অভাবে করোনা রোগীর প্রকৃত সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। করোনাভাইরাসে আক্রন্ত হওয়ার সব উপসর্গই থাকছে। কিন্তু অনেক সময় নমুনা পরীক্ষার আগেই মারা যাচ্ছেন রোগী। প্রতিদিনই এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। করোনা পজিটিভ আর উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর তালিকা করছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দেহ থেকে আর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে মৃত্যুর আগে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনার প্রথম ধাক্কার সময় যারা উপসর্গ নিয়ে মারা যেতেন তাদের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু গেল কয়েকমাস ধরে আর সেটি করা হচ্ছে না। সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়াদের আর নমুনা নেয়া হয় না।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরও বলছে, জনবল সংকটের কারণে এখন উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। তবে তাদেরও নমুনা পরীক্ষা গেলে করোনায় মৃতের সঠিক হিসাবটা অন্তত পাওয়া যেত। এখন সেটি হচ্ছে না। গত ২৪ ঘন্টায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে করোনায় ২জন ও করোনা ওয়ার্ডে ২জনের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ ঘন্টার পিসিআর টেস্টে ২১১ জনের পরিক্ষায় ১১১ জন করোনা পজিটিভ এসেছে। আক্রান্তের হার ৫২ দশমিক ৬১ শতাংশ। সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।বর্তমানে জেলাজুড়ে ছয় শতাধিক করোনা রোগি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল, বিভিন্ন ক্লিনিক ও বেসরকারী হাসপাতালসহ নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন।
পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, শহরের হাসপাতাল, নারিকেলতলা, পাকাপোল, নিউমার্কেট ও বড়বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণস্থানে পুলিশি টহল অব্যহত আছে। আছে উপজেলা শহরগুলোতেও। শহরের বিভিন্ন এলাকার লিংক রোডগুলোতে বাঁশ টানিয়ে মানুষ চলাচলে সীমিত করার কাজ অব্যহত আছে। সীমান্তে বিজিবি প্রহরার পাশাপাশি শহর ও প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করছে র‌্যাবও।
সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়ীয়া ইউনিয়নের নাদিম মাহমুদ (৪৫)। তিনি করোনার উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে আছেন। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা করাবেন না। তাঁর স্ত্রী, ছোটভাই, বৃদ্ধ চাচার জ্বর এবং কাশি রয়েছে। কিন্তু তারা কেউই করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে রাজি নন।
কেন নমুনা পরীক্ষা করাবে না, তার কারণ খুঁজতে জানা গেল ‘সামাজিকতার ভয়’। নাদিমের বড় ভাই রফিকুল ইসলাম। তিনি জানালেন, যদি করোনার নমুনা পরীক্ষা করানো হয় এবং রিপোর্ট পজিটিভ আসে; তাহলে মানুষ উল্টা-পাল্টা ভাববে। তাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করবে। আর রিপোর্ট পজিটিভ এলেই হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে তাদের ধারণা। সেজন্য তারা কেউ নমুনা পরীক্ষা করাবে না।
নাদিমের কথার সত্যতা পাওয়া গেল আরেকটি ঘটনায়। একই ইউনিয়নের বেলী গ্রামের আল নজিব মাহফুজ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর মাহফুজের বাড়ি লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লকডাউন করার পর স্থানীয় মানুষজন মাহফুজদের বাড়ির প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখাচ্ছে। বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষজন নাক টিপে ধরে চলাচল করছে। একজন মন্তব্য করে বসলেন, ‘মাহফুজকে হয় হাসপাতালে রেখে আসুক, না হলে বাড়ি থেকে বের করে দিক!’
সোনাবাড়ীয়া ইউনিয়নের আক্কাস আলী (৬২) গত কয়েকদিন শ্বাসকষ্টে ভুগে বৃহস্পতিবার সকালে মারা যান। কিন্তু করোনার নমুনা পরীক্ষা করেননি তিনি। তাঁর বাড়ির আরও চার সদস্যের শরীরে করোনার নানা উপসর্গ বিদ্যমান। অথচ, তারাও কেউ নমুনা পরীক্ষা করাতে রাজি নয়।
পরীক্ষা না করার ফলে একজন থেকে আরেকজন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এখন জ্বর, কাশি আর সর্দিসহ নানা উপসর্গ। অথচ দু-একজন ছাড়া কেউ নমুনা পরীক্ষা করাতে চাচ্ছেন না। যে দু-একজন পরীক্ষা করছেন, তারা সচেতন মানুষ। কিন্তু এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।
কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লালটু ইসলাম বলেন, প্রায় বাড়িতে সবার জ্বর। প্রতিদিন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে আক্রান্তের হার। আমার ধারণা, সাধারণ মানুষ লজ্জা, ভয় ও লকডাউনের যাতাকলে কেউ পরতে চায় না। যে কারণে কেউ করোনা টেস্ট করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আর লকডাউন করেই আমাদের (উপজেলা প্রশসন) দায়িত্ব শেষ। তার চিকিৎসা, খাওয়া-দাওয়া ও পরিবারের অন্য সদস্যদের শারীরিক অবস্থা দেখার কেউ নেই। লকডাউন মানে সমাজে বা পাড়ায় একঘরে হয়ে থাকা। কেউই তার সাহায্য তো দূরের কথা নাক টিপে তার বাড়ি পার হচ্ছে। এ কথা লজ্জায় অন্যকে বলতে পারে না। কী পরিস্থিতি সামনে আসছে, আল্লাহ জানে।’
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু ফেসবুকে এক স্টাটাস দিয়ে লিখেছেন প্রায়ই বাড়িতে বা এক পরিবারের সবার জ্বর। প্রতিদিন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে, আক্রান্তের হার প্রায় ৬০%। আমার ধারণা সাধারণ মানুষ লজ্জা, ভয় ও লকডাউনের যাঁতাকলে কেউ পড়তে চায় না। যে কারনে কেউ করোনা টেস্ট করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য আল ফেরদাউস আলফা বলেন, তার ওয়ার্ডভুক্ত সাতক্ষীরা সদরের ভোমরা ইউনিয়ন এবং দেবহাটা উপজেলার সীমান্তবর্তী প্রায় প্রতিটি বাড়িতে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ঠ দেখা দিয়েছে। তবে তাদের প্রায় সকলেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
তবে দক্ষ জনবলের অভাবে করোনা পরীক্ষা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগ। আর ল্যাবরেটরিতে সংগ্রহ করা নমুনার স্তপ বাড়তে থাকলেও পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে করোনার নমুনা পরীক্ষার জটিলতা কাটছেই না। তবে সমস্যা সমাধানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলাতে করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষার হার প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেছেন, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। ল্যাবটেরির সংখ্যা ইতিমধ্যে ৪১টিতে উন্নীত করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের গতিও আরো বাড়াতে প্রায় ১২ হাজার মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।