নীরব কৃষি বিপ্লবের অগ্রসাধক কৃষককে বাঁচাতে দরকার বরাদ্দ: ‘উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড’ গঠনের দাবী
আবু সাইদ বিশ্বাস:উপকূলী জেলা সাতক্ষীরা থেকে: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণক্ষতা ও কৃষি খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্ধের অভাবে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে কৃষক সমাজ অবহেলিত ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। কঠোর পরিশ্রম ও কৃষি সাধনার পরও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। বরঞ্চ পেশা পরিবর্তস সহ উদ্বাস্তু হচ্ছে অসংখ্য কৃষক। চলতি বাজেটে এসব কৃষকদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখার দাবী জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র অনুযায়ী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সময় চাষাবাদযোগ্য ২৫৫ লাখ একর জমিতে ১০০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হতো, সে তুলনায় ২০২০ সালে জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়ালেও এ সময় ২৫০ লাখ একর জমিতে ধান উৎপাদিত হয়েছে ২৯৮ লাখ মেট্রিক টন অর্থাৎ প্রায় ৩ গুণ। দ্বিগুণ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য তিনগুণ বর্ধিত খাদ্যশস্য উৎপাদন নিঃসন্দেহে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি । ১৯৭০ থেকে ২০২০ সময়ে বাজেটে ক্রমান্বয়ে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দের হিস্যা যথেষ্ট হ্রাস (১৯% থেকে ৭%!) পাওয়া সত্ত্বেও এই প্রবৃদ্ধি একটি নীরব বিপ্লবের সাক্ষ্য বহন করেচলেছে। কৃষি বিপ্লবের এই অগ্রসাধক হলো দেশের আপামর কৃৃষক সমাজ।
কৃষির সামগ্রীক বিবেচনায় উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিঅর্থনীতির অবদান তুলনামূলকভাবে নিম্নমুখী। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি খাত প্রধানত শস্য ও অশস্য (নন-ক্রপ) এ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তারা বলেন, প্রথমত বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত হওয়ার কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদন তুলনামূলকভাবে এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়নি। একটি গবেষণায় দেখা যায় ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৭ সালের মধবর্তী মাত্র ১৩ বছরে জাতীয় পর্যায়ে যেখানে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ শস্য (খাদ্য ও অর্থকরী ফসল) উৎপাদিত হয়েছে সেখানে উপকূলীয় অঞ্চলে একই সময়ে শস্য উৎপাদন বাড়েনি বরং কমেছে। উজান থেকে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও চাষাবাদ পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েও কাঙ্খিত ফল আসেনি।
বঙ্গোপসাগরের তীরে ও বিশ্বের সেরা গহিন গরান বনের নীড়ে গড়ে ওঠা গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির এক বিচিত্র বিলাস। প্রকৃতি এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের ভালোবাসা দিয়ে রানীও করেছে আবার ভিখারীও বানিয়েছে। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তনদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল। দেশের শতকরা ২৫ ভাগ জনগণ যেমন এই উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ অবদানও এই অঞ্চলেরই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চল, এখানকার অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানান দৈব-দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার।
১৭৯৭ থেকে শুরু করে এই সাম্প্রতিক ২০০৯ সালের আইলা পর্যন্ত সময়ের শুমার পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে মোট ৪৭৮ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, নার্গিসেরা বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পর পর। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছুটা আগে থেকে বিগত ৬১ বছরে ১৮৪টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে ঘন ঘন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সিডর আর আইলার আঘাতে সুন্দরবনও পর্যুদস্থ হয়। এর পর মাহাসেন, নার্গিস, ফণী, বুলবুল, আম্পান এবং এই সেদিন ইয়াসও কম ক্ষতির কারণ হয়নি।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে এটা প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, জাতীয় অর্থনীতির আন্তঃসলিলা শক্তির উদ্বোধন যার হাতে সেই সবচেয়ে বেদনায় বিবর্ণ। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো অর্থনীতির অনেক প্রবণতার সূচক সন্ধানে কালাতিপাত করে কিন্তু উপকূলীয় জেলা নিচয়ের আর্থ-সামাজিক চালচিত্রের, খানা-পুরি থেকে শুরু করে ভূমিবন্টন ব্যবস্থা, চাষাবাদের হাল-হকিকত, প্রাণিসম্পদের সালতামামি অনেক কিছুরই বাস্তবতার ব্যাখ্যা তাদের কাছে নেই। উপকূলীয় অঞ্চল যেন শুধু দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মাথাব্যথা সূত্রে সমুপস্থিত শুধু আকালের দিনে নাকালের মোহনায় এবং একমাত্র মিডিয়ায়।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পড়ে তাপমাত্রার পরিবর্তনপ্রসূত তারতম্য সূত্রে সমুদ্রের তলদেশ স্ফীত হয়ে ওঠার ফলে পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে বিশ্বের প্রায় সব সমদ্র উপকূল বেষ্টনীতে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বাংলাদেশের জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের অশনি সংকেত দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল, বিশেষ করে অদূরবর্তী দ্বীপাঞ্চল সামান্য জলোচ্ছ্বাসের ছুতানাতাতেই তলিয়ে যাচ্ছে, তা উদ্ধারে বশংবদ কোনো কার্যক্রম সফল হচ্ছে না। সুন্দরবনের প্রাণিবৈচিত্র্য বিপন্ন হতে চলেছে এর প্রভাবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির জন্য তা দারুণ দুঃসংবাদ বৈকি হতে পারে।
এমতাবস্থায়, উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিঅর্থনীতি ও বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের সুরক্ষা নিয়ে ভবিষ্যবাদী কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করা দাবী উঠেছে। পাশাপাশি আগামী দিনে বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক সমুদ্রঅর্থনীতি বা ‘নীল অর্থনীতি’ বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন বিশেষ পরিকল্পনা। এসব লক্ষ্য পূরণে জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ একটি ‘উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করে বিশদ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, মোদ্দা কথায় সময়ের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথাসময়ে যথাপ্রযতœ প্রদান করা সম্ভব না হলে, উষ্ণায়নের প্রভাবক ক্ষয়ক্ষতিকে যথা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করা সম্ভব না হলে সমূহ সম্ভাবনাময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অবদান থেকে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় অর্থনীতি শুধু বঞ্চিতই হবে না, সময়ের অবসরে জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি গোটা দেশ ও অর্থনীতির জন্য দুর্ভাবনা-দুর্গতির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।