শালীনতা বনাম প্রগতি : আজকের সমাজ বাস্তবতা
-বিলাল মাহিন
কোনো ধর্মই মানুষকে অনৈতিক আচরণ শেখায় না। এমনকি অশ্লীলতা বেহায়াপনাকে কোনো সমাজ ও ধর্মই নৈতিক অনুমোদন দেয় না। সনাতন ধর্মে প্রতিটি মানুষকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দেওয়া হলেও অশ্লীলতা ও নগ্নতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। বরং সনাতন ও ইসলাম ধর্মসহ প্রায় সকল ধর্মেই সংযত চরিত্র গঠনের প্রতি জোর তাকিদ দেয়া হয়েছে। সনাতন ধর্মে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্যই ঈশ্বর একই বিধান দিয়েছেন। ছেলের জন্য এক বিধান আর মেয়ের জন্য আরেক বিধান-এমন পক্ষপাতিত্ব ঈশ্বর করেন না। যেমন: ঋগ্বেদে (৮/৩৩/১৯) বলা হয়েছে “হে পুরুষ ও নারী! তোমাদের পোশাক ও দৃষ্টি সর্বদা ভদ্র ও অবনত হোক। তোমাদের চলন সংযত হোক, দেহ পোশাকে আবৃত হোক, নগ্নতা পরিত্যাগ হোক।” শ্রীরামচন্দ্র বলেছেন: “পোষাক নয়, চরিত্রই একজন নারীর প্রকৃত আবরণ।” (বাল্মীকী রামায়ণ: ৬/১১৪/২৭)
একইভাবে ইসলাম ধর্মে অন্যায়, অত্যাচার, পাপাচার, যিনা-ব্যভিচার, অবৈধ যৌন সম্পর্ক, জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতিসহ অসামাজিক সব কার্যকলাপ হারাম তথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পর্দা করলেই কোন নারী সতী হয়ে যায় না, যদি সেই নারীর চরিত্র ভালো না হয়। আবার পর্দা তথা শালীন পোশাক-পরিধান ছাড়া নারীর সতীত্ব রক্ষা করাও কঠিন। পর্দা করলেই কোন নারী নিরাপদ নয়, যদি পুরুষের দৃষ্টি ভদ্র ও অবনত না হয়। ছেলে মেয়ে উভয়ের চলন সংযত না করতে পারলে পর্দার ভিতর ঢুকে গেলেও কোন লাভ হবে না। পবিত্র কুরাআনে পুরুষ ও নারী উভয়কেই তাদের দৃষ্টি সংযত রাখতে এবং লজ্জা স্থানের হেফাজত করতে বলা হয়েছে।
আমাদের নারীবাদী ও অতি প্রগতিশীলরা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অতি আধুনিকতার নামে বাইরে (সর্বসাধারণের জন্য) নিষিদ্ধ মদ, মাদক ও নেশাদ্রব্য লাইসেন্সধারী বড় বড় পাঁচ তারকা হোটেল, ক্লাব ও বারে বৈধতা পায় বিত্তবানদের জন্য। আমাদের দেশের এক শ্রেণির নারী মডেল ও তারকারা শুধু অর্থ আর দ্রুত খ্যাতি লাভের আশায় নিজেকে অর্ধনগ্ন করে উপস্থাপন করেন, নাইট ক্লাবে যান, ডিজে নৃত্যের পসরা সাজান। আবার যৌন হয়রানী বা ধর্ষণের শিকার হয়ে কেঁদে বুক ভাসান। অর্থাৎ চলাফেরা পাশ্চাত্য স্টাইলে আর যৌন হয়রানীর শিকার হলে সৌদি আইনে বিচার প্রার্থনা!
আমাদের নেতা-নেত্রীরা একদিকে তাহাজ্জুদ আদায় করছেন, হজ্ব-ওমরা করছেন আবার তারাই নাইট ক্লাব, হোটেল ও বারের লাইসেন্স দিচ্ছেন। একদিকে মডেল মসজিদ নির্মান হচ্ছে, অপরদিকে সেই মসজিদের ইমাম-খতিবগণ হামলা-মামলার শিকার হচেছন, গুম-খুন হচ্ছেন। আমরা বৃক্ষ রোপন করছি, গাছ লাগাতে উৎসাহিত করছি আবার সুন্দরবন উজাড় করে বিদুৎ কেন্দ্র করছি। নীতি-নৈতিকতা কেবল কেতাবে আছে বাস্তবে নেই।
পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষার নিশ্চয়ন দরকার। যদিও ধর্ষণ সম্পর্কিত প্রচলিত আইনটির মৌলিক ও ব্যাপক সংস্কার ও পরিবর্তনের দরকার রয়েছে। ধর্ষণ যাতে না হয় তার জন্য রাষ্ট্রিয় ও সামাজিকভাবে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সফল বাস্তবায়ন দরকার। শুধু আইন বা শাস্তির মাধ্যমে ধর্ষণ মুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার নারীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
জনগণের শিক্ষা, সচেতনতার মান, সাংস্কৃতিক চেতনায় নারীবান্ধব তথা জেন্ডার সংবেদনশীল না হওয়ায় আইন করেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আরও অনেক জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে। পরিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কৃতিতে জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রতিফলন ঘটতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে স্ব স্ব ধর্মের নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভূথ্যান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। নারীর অগ্রযাত্রার একেকটি ধাপ। রাজনৈতিক লড়াইয়ে যেমন ছিল নারীর অংশগ্রহণ আবার সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে এ দেশের নারীরা খুলে দিয়েছে আলোর উৎস-দ্বার। এভারেস্ট্রের চূড়ায় বাংলাদেশের নারীরা এঁকেছেন বিজয়গাথা। খেলার মাঠেও নারীদের অগ্রযাত্রা সমতার সমাজ নির্মাণের পথকে সুগম করছে। কিন্তু, নারীর সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে নি সমাজ ও রাষ্ট্র। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে দরকার নৈতিক শিক্ষা ও পোশাকে-আচরণে, চলনে-বলনে শালীনতা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রায় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাও অন্যতম সহায়ক হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এগুলো আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার নারী। এখন দেশের কয়েকটা জেলার ডিসি নারী, পুলিশের এসপি-ওসি থেকে শুরু করে সিভিল প্রশাসন এবং সেনা-নৌসহ বিভিন্ন বাহিনীতে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটি বিশ্বের বিরল ঘটনা এবং নারী অগ্রযাত্রার অন্যতম প্রেরণা।
লক্ষ্যণীয় যে এই দেশেরই কিছু কুসংস্কারাছন্ন এবং অতি প্রগতিশীল মানুষ এখনো নারীকে ভোগ্য পণ্য মনে করে। তারা নানাভাবে নারীর অগ্রযাত্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বায়নের পুঁজিবাদী চর্চা নারীকে পণ্যে রূপান্তরের চেষ্টা করছে। তথাপি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নারীরা কাজ করছে সমানতালে। দিন দিন যেভবে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে নারীদের জন্য আলাদা কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নারীর এই অগ্রযাত্রা অব্যহত থাকুক। প্রগতি উন্নয়ন অব্যহত থাকুক শালীনতার সাথে। জয় হোক মানুষের। সুন্দর হোক পৃথিবী।
বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।