২০ জুন ২০২১: ক্রােইমবাতা রিপোটধ আবু সাইদ বিশ্বাস: করোনায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সাতক্ষীরায় শিশু-কিশোরা অনলানেন ভিডিও গেম খেলে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকছে তারা। কেউ কেউ কিছুক্ষণ অনলাইন ক্লাসে থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই খেলছে মোবাইলফোনে গেম। এই গেম খেলতে গিয়ে তারা অনলাইনে অভিভাবকদের প্রচুর অর্থও নষ্ট করছে। এই গেইম শিশু-কিশোরা এতটায় আসক্তি হয়ে পড়েছে যে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে নিয়মিত গলযোগ হচ্ছে। প্রতিটা পরিবার যেন অশান্তির দ্বাবানলে জ¦লছে। সংসারে শান্তি উঠে যাচ্ছে। অনলাইন গেমস যুব সমাজের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে অভিভাবক, মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।
প্রযুক্তির প্রতি বেশি আসক্ত হওয়ার কারণে যাদের নিয়ে এত টেনশন তারা কী ভাবছে? এই নিয়ে সাতক্ষীরা সরকারী বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর সাফ জবাব, ‘স্কুল বন্ধ। বাইরে খেলতে যেতে পারি না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না। বাসায় বসে কতক্ষণ টিভি দেখবো, বই পড়বো? সারাদিন কী করবো? তাই গেম খেলি, অনলাইনে বন্ধুদের সঙ্গে কথাও বলি।’
কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রের ঝটপট উত্তর, ‘করোনার জন্য স্কুলে যেতে পারছি না। বাইরে খেলতে, ঘুরতে আর কোথাও বেড়াতে যেতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে মোবাইলফোনে গেম খেলি। আমার ভালোও লাগে। তবে, টাকা দিয়ে কোনো গেম খেলি না।’
খেলছেন পাবজি অথবা ফ্রি-ফায়ার। আলাদা দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ করছেন ভিন্ন কোনো দেশের গ্রুপের ওপর। প্রতিপক্ষকে দমনে ব্যবহার হচ্ছে পিস্তলসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র।
অনলাইনে গেমস খেলার বিষয়ে একজন খেলোয়াড় বলেন, বেশিরভাগ আমরা গ্রুপ খেলি। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। যেমন পাকিস্তান, ভারত। ওদের চারজনের একটি দল থাকে আর আমাদের বাংলাদেশি চারজনের দল থাকে। যাদের সামর্থ্য বেশি তারাই জিতে যায়। তাই মাঝে মাঝে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে টাকা খরচ করেও কিনছে এসব অস্ত্র।
পাবজি বা ফ্রি-ফায়ার গেমগুলো খেলতে গিয়ে মাদকে আসক্ত হচ্ছে অনেকেই, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরিবার থেকে। কখনও কখনও জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ জগতে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই গেমগুলো আসলে যারা খেলে- শিশু হোক, বড় হোক তাদের মস্তিষ্কে কিছু কেমিক্যাল পদার্থ নিঃসরণ হয়। বারবার সেই গেমটি খেলার জন্য তাকে প্ররোচিত করে। যেটাকে আমরা বলি নির্ভরশীলতা বা আসক্তি। শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে। তাদের আক্রমণাত্মক করে তোলে।
বিশেজ্ঞরা বলছে, আগে যেখানে স্কুলের পড়া শেষে শিক্ষার্থীরা একটি ভালো গল্পের বই খুঁজত, সংগীত কিংবা ছবি আঁকার ক্লাসে ঢুকত, দেয়াল পত্রিকা কিংবা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিত, সেখানে এখন শিক্ষার্থীরা স্কুলের ক্লাস ভুলে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে পাবজি, ফ্রি ফায়ার কিংবা গ্র্যান্ড থেফট অটো খেলায়। শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা হিংসতা ও যৌনতাযুক্ত এই খেলাগুলো নিষিদ্ধ করার পক্ষে অভিমত দেন, যা অনেক দেশে হচ্ছে। অনলাইনে ভালো কনটেন্ট, খেলা দেওয়ার পরামর্শ তাদের।
জনপ্রিয় ডিজিটাল প্রতিটি গেমই ভয়ংকর সন্ত্রাস, সহিংসতা, যুদ্ধ আর মৃত্যুর গল্প। গেমগুলোতে যেমন সহিংসতা, তেমনি ভিডিও স্ট্রিমিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন টিকটক, বিগো লাইভে অশ্নীলতার ছড়াছড়ি। এই মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে বাড়ছে নানা ধরনের প্রতারণার ফাঁদ আর অপরাধ কর্মকান্ড। একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, আসলে এই গেমগুলো অমানবিক, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী একটি আগামী প্রজন্ম তৈরির আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বিশ্ব সমাজের প্রভাবশালী একটি অংশ নিজেদের সন্তানদের সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহে রেখে তাদের নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটি অনুগত প্রজন্ম তৈরি করছে। আর একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, আসলে বিশ্বে যে প্রভাবশালী দেশগুলো অস্ত্র বাণিজ্য আর সন্ত্রাসকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার করে রেখেছে বছরের পর বছর, তারাই আসলে এসব গেমের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসকে সাধারণ বিষয় হিসেবে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। এই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভবিষ্যৎটা এমন হবে যখন চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ যন্ত্রণাকাতর মানুষ দেখে আর বিচলিত হবে না মানুষ।
এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এসব অনলাইন গেম নিষিদ্ধ করেছে। অনেক দেশ নিয়ন্ত্রিত করেছে। বাংলাদেশেও পাবজি, ফ্রি ফায়ারের মতো সন্ত্রাসের গেমগুলো বন্ধের দাবী জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাবজি-ফ্রি ফায়ার, শুধুই সন্ত্রাস : একশজনের একসঙ্গে খেলার দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানির ভিডিও গেম পাবজি। পরিত্যক্ত একটি দ্বীপে একশজন মানুষ থাকে। সেখানে প্যারাসুট দিয়ে নামে খেলোয়াড়। এরপর শুরু হয় টিকে থাকার যুদ্ধ। চারজনের গ্রুপ করেই এটি খেলা যায়। একজন কিংবা চারজন খেলোয়াড় মেতে ওঠে ওই একশজনকে হত্যার মহাআয়োজনে। এই খেলার মূল উপজীব্য হত্যা করে টিকে থাকতে হবে। ‘টু সারভাইভ, নিড টু মোর কিল’ এটাই হচ্ছে এই গেমের মূলমন্ত্র। হত্যার পর হত্যা করে টিকে থাকতে পারলেই খেলায় জয়ী হবে ব্যক্তি বা গ্রুপ। ফ্রি ফায়ারও অনেকটা পাবজির আদলেই তৈরি করা। ব্যক্তিগতভাবে কিংবা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে হত্যা আর সন্ত্রাসই মূল উপজীব্য। বিশ্ব পরিসংখ্যানে এ দুটি গেমই সবচেয়ে বেশি খেলা হচ্ছে।
একাধিক সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে প্রতিদিন ৮৭ কোটি মানুষ পাবজি-ফ্রি ফায়ার খেলছে। বাংলাদেশে এর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। সাতক্ষীরা জেলাতে যার সংখ্যা প্রায় ৭ লক্ষ। গুগল প্লে স্টোর ও আই স্টোর থেকে প্রতিদিন ডাউনলোড হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি। বাংলাদেশেও প্রতিদিন এক কোটির বেশি গেম খেলার পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে একাধিক অনলাইন সমীক্ষা থেকে।
যতগুলো গেম অনলাইনে পাওয়া যায় তার মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তার গেম ‘মাইন ক্রাফট’। এই গেমে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে বাড়ি, স্থাপনাসহ চোখের সামনে দেখা অনেক কিছুই বানাতে পারে খেলোয়াড়। কিন্তু এই গেমটি জনপ্রিয়তায় ফ্রি ফায়ার, পাবজি, জিএটি থেকে অনেক পেছনে।
ইদানীং জনপ্রিয় ইমো, বিগো লাইভ, লাইকি, টিকটক। অতি সম্প্রতি সিআইডির অভিযানে বিগো লাইভকে কেন্দ্র করে অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত একটি গ্রুপ ধরা পড়েছে। এর আগে টিকটকে নায়িকা হওয়ার প্রলাভনে ভারতে কয়েকশ নারী পাচারের তথ্যও প্রকাশ হয়েছে।
পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেম প্রতিবেশী ভারত ও নেপালে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশই এই গেমগুলো নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের সন্ত্রাসনির্ভও গেম এখনই নিষিদ্ধেও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানিয়েছে
সংশ্লিষ্টরা।
Check Also
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। …