১৯৮২ সালে পাঁচ প্যাকেট পাটের বীজ বিক্রিতে ৫০ পয়সা করে মোট আড়াই টাকার অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন কুষ্টিয়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তৎকালীন পাট সম্প্রসারণ সহকারী মুক্তিযোদ্ধা মো. ওবায়দুল আলম আকন। চাকরি হারানোর পাশাপাশি কারাবরণও করতে হয়েছিল পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনামল অবৈধ ঘোষণার পর আদালতের মাধ্যমে দীর্ঘ ৩৯ বছর পর নিজের অধিকার বুঝে পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুল আলম।
মুক্তিযোদ্ধা আকন জানালেন, তিনি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে মাত্র আড়াই টাকার অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ১৯৮২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সামরিক শাসনামলে ওই অনিয়মের ঘটনায় দায়ের করা অভিযোগে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে দুই মাসের কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয় তার। ওই আদেশের পর চাকরি থেকেও বহিষ্কার করা হয় তাকে।
মো. ওবায়দুল আলম আকন বলেন, ‘চাকরি যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। বহু সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল। মানুষ আমাদের দেখিয়ে বলতো আড়াই টাকার জন্য চাকরি গেছে। আমার স্ত্রী একটি স্কুলে চাকরি নেয়। তার বেতন আর আমার টিউশনির টাকায় কষ্টে দিন কেটেছে।’
দুই মাসের সাজা খেটে বের হওয়ার পর একে একে পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়। সংসার নিয়ে আকন ও তার স্ত্রী পড়েন চরম বিপাকে। কখনও রান্নার চালও থাকতো না বাসায়। ধারদেনা করতে হতো নিয়মিত। তবে সঙ্কটের মধ্যেও সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে ভোলেননি তারা দুজন। এখন বড় ছেলে জনতা ব্যাংকে, ছোট ছেলে কৃষি ব্যাংকে চাকরি করেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে পড়ছে ইডেন মহিলা কলেজে।
২০১১ সালে এরশাদের জারি করা সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এরপরই চাকরি ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন ওবায়দুল আলম আকন।
ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ ওই ব্যক্তিকে তার উপযুক্ত বা প্রকৃত পদে বহাল করে সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়াসহ পুনর্বহালের নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে ১৯৮২ সালের ঘটনায় দায়ের করা অভিযোগে তাকে দেওয়া দণ্ড ও জরিমানার আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে আপিল আবেদন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। ২০২০ সালের ৮ মার্চ ওই আপিল খারিজ করেন সুপ্রিম কোর্ট। আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে অধিদফতরের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন জানালেও সোমবার (২৮ জুন) তা খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
মো. ওবায়দুল আলম আকনের ছোট ছেলে মো. সোহেল আকন বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই অভাব আমাদের ছেঁকে ধরেছিল। সব সহ্য করেছি। মানুষের কথাও সহ্য করেছি। সেদিন চলে গেছে। গতকাল (২৮ জুন) আপিল বিভাগের রিভিউ রায়ের পর অনেকেই আমার বাবাকে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেন। বাবার অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে দেখে আমরাও গর্বিত। এ মামলায় ব্যারিস্টার নাসরিন আক্তার চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী এবং নোমান হোসেন তালুকদারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা তাদের সঠিক প্রাপ্য দিতে পারিনি।’
মুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুল আলম আকন বলেন, ‘দুই ছেলে বড় হয়েছে। স্বাবলম্বী হয়েছে। রায়ের পর বকেয়া বেতন-ভাতা বাবদ বেশ কিছু টাকা পাবো। কিছু টাকা দিয়ে সুযোগ হলে দুই ভাই হজে যাব। গ্রামের বাড়ি মেরামত করে সেখানে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। আদালত, আইনজীবী ও সাংবাদিক সবার কাছেই কৃতজ্ঞ।