আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা -বিলাল মাহিনী

সু-শাসন নিশ্চিত হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের  শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা আর্থ-রাজনৈতিক অগ্রগতিকে প্রাধান্য দেয়। বিগত দশকগুলিতে বাংলাদেশে আইনের শাসন ও জবাবদিহিতার সুষ্ঠু  বিকাশ ঘটেনি,  দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হরতাল-অবরোধ রাজনীতির  নিত্যসঙ্গী। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতির হার অত্যন্ত উচ্চ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নয়ন হলেও বাংলাদেশে সুশাসনের মাত্রা সন্তোষজনক নয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশাসনসহ প্রতিটি খাত আজ দুর্নীতি জ্বরে আক্রান্ত। সুখী-সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়তে তাই প্রয়োজন দায়িত্বশীল পর্যায়ে আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, মানুষকে সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং সুশৃংখলভাবে পরিচালনার জন্য যে নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয় তাকে আইন বলে। আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ law যা lag নামক শব্দ থেকে উদ্ভুত। lag এর আভিধানিক অর্থ স্থির, অপরিবর্তনীয় এবং যা সর্বত্র সমানভাবে প্রযোজ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন হলো সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক বলবৎযোগ্য বিধান, যা সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়। আইন বলতে সামাজিকভাবে স্বীকৃত লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে বোঝায়। ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিষ্টটল লিখেছিলেন, “আইনের শাসন যেকোন ব্যক্তি শাসনের চেয়ে ভাল’’।
অধ্যাপক গার্নার-এর ভাষায়, আইনসম্মতভাবে সরকারের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত স্তরে চৌকিদার পর্যন্ত সকল কর্মচারীকে নিয়ে যে বিভাগ গঠিত হয়, সেই বিভাগকে শাসন বিভাগ বলা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
মানুষ মাত্রেই দায়িত্বশীল। সে হোক একটি পরিবারের সদস্য অথবা রাষ্ট্রের কর্তা বা জনপ্রতিনিধি। মহানবি হযরত মুহাম্মাদ স. বলেন, “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং (শেষ বিচারের দিন) তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।” ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রা. বলেছেন, ‘ফোরাতকূলে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায়, তবে এর জন্যও আমি ওমরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’ ইসলামের ত্রাণকর্তা খ্যাত প্রথম খলিফা আবু বকর রা. নিজে ব্যবসায়ী ছিলেন। ইসলামের জন্য, রাষ্ট্রের কল্যাণে তথা মানুষের জন্য তিনি এমনভাবে দান করতেন যে, দানশেষে তার গৃহে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স. ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। একইভাবে তৎকালিন শিল্পপতি দানবীন হযরত ওসমান রা. তার বিপুল পরিমান অর্থ-সম্পদ থেকে দুই তৃতীয়াংশ পর্যন্ত দান করে দিতেন। সুতরাং জনগণের জান মালের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের ক্ষুধা নিবারণে শাসকবৃন্দের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক এক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।’ আসলে আইনের শাসন শুধু বিচারক আর আইনজীবীদের সাথেই সম্পৃক্ত নয়। এর সাথে সম্পৃক্ত জনগণের ন্যায়বিচার, শান্তি, সম্মান আর সমঅধিকার পাওয়ার মৌলিক ভিত্তি। এই দেশকে একটি নিয়মতান্ত্রিক সুশৃঙ্খল রাষ্ট্ররূপে দেখার যে অপার আকাঙক্ষা মানুষের, তার সাথে সুশাসনের প্রতিফলন ঘটলেই কেবল মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকার নিশ্চিত হতে পারে।

বিভিন্ন সংবাদপত্রে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো, গত এক বছরে বাংলাদেশ আইনের শাসনের সূচকে আরো কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেছে। এদিক দিয়ে বিশ্বের ১২৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম (রিপোর্ট-২০২০)। আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট প্রতি বছর এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকে গত বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ১২৬টি দেশের মধ্যে ১১২তম অবস্থানে ছিল। ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা প্রয়োগ, নাগরিকদের প্রাপ্তি ন্যায়বিচার এবং ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মৌলিক অধিকারের দিক থেকে।

সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; জবাবদিহিতা। আইনের শাসনের যে অবনতি ঘটেছে, তা হলো- মূলত প্রশাসনের কাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে কোথাও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নেই। জবাবদিহিতার এই ব্যবস্থাটা হতে পারত আসলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। এ কারণেই সেটা হচ্ছে না যে, এর গঠন প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম ঘটেছে। খোদ সংসদ নিয়েই সেখানে প্রশ্ন রয়েছে, যার প্রতি মানুষের আস্থা নেই। তারা কিভাবে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে?
আইনের শাসন ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনসহ ১১ দফা দাবি জানিয়েছে নাগরিক নিরাপত্তা জোট। তাদের অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে- আটক বা গ্রেফতারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনে চলা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা, বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত উন্নয়ন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা এবং মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে প্রতিনিয়ত অন্যায়, অবিচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, নির্যাতন, মতপ্রকাশ ও মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত, নারী ও শিশু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের মতো জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তারা বলেন, রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও জবাবদিহিতার অভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নাগরিকের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে আরও বেশি প্রকট করে তুলেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি, সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা জনগণের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে বা দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। সরকার ও প্রশাসনে কোনো জবাবদিহি নেই।
আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা :
দূর্বল শাসনব্যবস্থার অন্যান্য লক্ষণগুলো হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল, নিম্নমানের সেবা প্রদান এবং লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা।
সুশাসনের প্রধান উপাদানগুলো হচ্ছে- জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণ, আইনের শাসন, একতা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, স্বচ্ছতা, দূর্নীতির অপব্যবহার, তথ্য অধিকার, প্রশাসনিক দক্ষতা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা: মেধাভিত্তিক সরকারী চাকুরী, ইত্যাদি।
জবাবদিহিতা : শক্তিশালী রাজনৈতিক জবাবদিহিতা উন্নয়নের উদ্দ্যশ্য অর্জনে সহযোগিতা করে। মানুষের উন্নয়নের সাথে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা জড়িত, কারণ এটি গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন। এটি হচ্ছে সুশাসনের মূল চাবিকাঠি। শুধুমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, বেসরকারী এবং সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই জনগণ এবং তাদের স্টোকহোল্ডারদের কাছে জবাবদিহি হতে হবে। যদি রাজনৈতিক জবাবদিহিতা দূর্বল হয় তবে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উভয় উন্নয়নই প্রভাবিত হয়। দূর্নীতি কমানোর মাধ্যমে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রাজনৈতিক জবাবদিহিতার প্রথম শর্ত হচ্ছে “অবাধ এবং নিরপেক্ষ”(free & fair) নির্বাচন। “অবাধ” অর্থ প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা ব্যবহারের সমান সুযোগ। নিরপেক্ষ অর্থ নির্বাচনী আইনের প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা। রাজনৈতিক জবাবদিহিতর আর একটি শর্ত হচ্ছে জবাবদিহি। গণমাধ্যমে রাজনৈতিকদের দ্বারা জনগণ পূর্ণ জবাবদিহিতা এবং সমর্থন গ্রহণ করে। দূর্নীতি, টাকার বিনিময়ে ক্ষমতা এবং মানবাধিকার লংঘন এগুলো প্রকাশ করার জন্য স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের প্রয়োজন। জবাবদিহিতার জন্য আইনের প্রয়োজন, যেগুলো নির্বাহী সদস্যদের জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। জবাবদিহির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিরোধীদলের কার্যকরী অংশগ্রহণ।
যখন আইন এবং নীতি মেনে কোন সিদ্ধান্ত  গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়ন করা হয় তখন তাকে স্বচ্ছতা বলে। তাই প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। আইনের শাসন : সুশাসনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ন্যায়সঙ্গত কার্যকাঠামো এবং তার নিরেপেক্ষ ব্যবহার। এছাড়াও এর জন্য প্রয়োজন মানবাধিকারের পূর্ণ নিশ্চয়তা, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের। তবে কোনো আইনই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারবে না; যতক্ষণ না নৈতিকতা সমৃদ্ধ নাগরিক তৈরি করা যাবে। তাই নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ নাগরিক তৈরিতে রাষ্ট্র ও সমাজের সকলকে মনযোগি হওয়া দরকার।

বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও  নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর। জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট।

Check Also

সাতক্ষীরায় বিজিবির অভিযানে দশ লাখ টাকার মালামাল আটক

সাতক্ষীরা ও কলারোয়া সীমান্তে চোরাচালান বিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে মাদকদ্রব্যসহ প্রায় দশ লক্ষ টাকার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।