প্রাণী মাত্রেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। পৃথিবীর প্রতিটি জীবের মৃত্যু হবে; এটাই চিরসত্য, চরম বাস্তবতা। সেই মৃত্যু কতোটা সুন্দর ও সাবলীল হবে সেটাই মূখ্য বিষয়। মানুষের মৃত্যুতে মানুষ কাঁদে। আবার কিছু কিছু মৃত্যুতে মানুষ উল্লাসে হাসে। তাইতো কবি বলেছেন, ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। তাই যাতে আমার আপনার মৃত্যুর পর চারপাশের মানুষেরা ইন্না লিল্লাহ.. পড়ে, সমবেদনা প্রকাশ করে, চোখের পানি ফেলে এবং দু’হাত তুলে মহান স্রষ্টার দরবারে দোয়া করে; সেজন্য জীবিত থাকাবস্থায় মানুষের অপর মানুষের অধিকার রক্ষা ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। পৃথিবীর সব আত্মাকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে অধিক বর্ণনা রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’ (সুরা আনকাবুত : ৫৭), আর এ মৃত্যু হয়ে থাকে আল্লাহর নির্দেশে। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মৃত্যুবরণ করতে পারে না। সে জন্য একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪৫)
মৃত্যুকালীন অবস্থা কিংবা মৃত্যুর সময় বলে-কয়ে আসে না, তবে এটা অনিবার্য সত্য। অনেকে দীর্ঘ রোগভোগ শেষে মারা যান, অনেকে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপরও ‘সাকরাতুল মাওত’ বা মৃত্যুযন্ত্রণা বলে একটা কথা শোনা যায়, এটা আসলে কী? থাকলে তার কষ্ট কেমন? ইসলামি স্কলারদের মতে, সাকরাতুল মাওত সত্য এবং প্রত্যেকেই তা মৃত্যুর সময় অনুভব করবে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে মরণাক্রান্ত ব্যক্তির জ্ঞানহীন একটি অবস্থা হবে, সেটি কমবেশি রকমের কষ্টকর হবে এবং তার ছাপ মৃত ব্যক্তির চেহারায় ফুটে উঠবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে। (অথচ) এ থেকেই তোমরা অব্যাহতি চেয়ে আসছো।’ (সুরা কাফ : ১৯)
হযরত আয়েশা রা. নবি করিম সা.-এর মৃত্যুকালীন অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, হযরত রাসুলুল্লাহ সা. তার বুকে ও কাঁধে ঠেস দিয়ে বসা ছিলেন। এমন সময় হযরত আয়েশা রা.-এর ভাই হযরত আব্দুর রহমান রা. সেখানে উপস্থিত হন। তার হাতে কাঁচা মিসওয়াক দেখে সেদিকে রাসুলুল্লাহ সা.-এর দৃষ্টি গেল। হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি তার (রাসুল সা.) আগ্রহ বুঝতে পেরে রাসুলের অনুমতি নিয়ে মিসওয়াকটি চিবিয়ে নরম করে তাকে (রাসুলকে) দিলাম। তখন তিনি সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন ও পাশে রাখা পাত্রে হাত ডুবিয়ে (কুলিসহ) মুখ ধৌত করলেন। এ সময় তিনি বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর রয়েছে কঠিন যন্ত্রণাসমূহ।’ (সহিহ্ বুখারি : ৪৪৪৯)
এমন সময় তিনি ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে হাত কিংবা আঙুল উচিঁয়ে বলতে থাকলেন, ‘(হে আল্লাহ!) নবিরা, সিদ্দিকরা, শহীদরা এবং নেককার ব্যক্তিরা যাদের তুমি
পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের সাথী করে নাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করো ও দয়া করো এবং আমাকে আমার সর্বোচ্চ বন্ধুর সঙ্গে মিলিত করো। আল্লাহ! আমার সর্বোচ্চ বন্ধু!’। হযরত আয়েশা রা. বলেন, শেষের কথাটি তিনি ‘তিন বার’ বলেন। অতঃপর তার হাত এলিয়ে পড়ল, দৃষ্টি নিথর হয়ে গেল।’ তিনি সর্বোচ্চ বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হলেন। (সহিহ্ বুখারি : ৪৫৮৬, ৫৬৭৪)
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, নেককার বদকার নির্বিশেষে মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যম্ভাবী। নেককারের জন্য শেষ সময়ে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ হতে পারে, বদকারেরও হতে পারে, ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ বলেন, আমি চাই না মৃত্যুযন্ত্রণা আমার জন্য লাঘব হোক। কেননা সেটাই আমার জন্য শেষ সুযোগ। ক্ষমা নসিব হলে গোনাহমুক্ত ব্যক্তির স্পর্শ পেয়ে ফেরেশতারা খুশি হবেন, কবর পর্যন্ত সঙ্গ দেবেন।
সব ইমাম এ বিষয়ে একমত যে একমাত্র শহীদদের মৃত্যু কষ্টবিহীন হবে। মনে হবে তার শরীরে একটা পিঁপড়া কামড় বসিয়েছে মাত্র। বাকিদের ব্যাপারে মৃত্যুযন্ত্রণা হবেই, অল্প বা বিস্তর। ইবনে হাজম আন্দালুসি তার ‘ মৃত্যু যন্ত্রণাময়’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেন, কোনো মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সেটা আসলেই কষ্টকর। কারণ এর কোনো আলামত দৃশ্যমান হয় না। তিনি বলেন, সাকরাতুল মাওত শারীরিক নয়, আত্মিক। কুরআনে কারিমে ‘তুমি যদি দেখতে’ এমন আয়াতে এ কথার সমর্থন মেলে। ‘যদি তুমি দেখতে যখন জালেমরা মৃত্যুযন্ত্রণায় থাকে এবং ফেরেশতারা স্বীয় হস্ত প্রসারিত করে বলে, বের কর স্বীয় আত্মা! আজ তোমাদের অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে অসত্য বলতে এবং তার আয়াতসমূহ থেকে অহংকার করতে।’ (সুরা আনআম : ৯৩)
পক্ষান্তরে ইমান আনার পর যারা দ্বীনের পথে অবিচল থাকে তাদের মৃত্যুর ফেরেশতা এ সময় অভয় দেয় এবং জান্নাতের সুসংবাদ শোনায়- নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোনো। (সুরা ফুসসিলাত : ৩০)
আল্লাহতায়ালা মানুষকে যেহেতু তার মৃত্যুর কথা জানিয়ে দিয়েছেন, সেহেতু তার উচিত হলো মৃত্যুর জন্য সদা প্রস্তুত থাকা। আর মুমিন যেহেতু বিশ্বাস করে তার মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন আছে, সেহেতু তার কর্তব্য হলে পারলৌকিক জীবনের সুখের জন্য কাজ করা। তাদের ভাবা দরকার, আমাদের আগে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের অনেকের কবরও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের অবস্থাও অনুরূপ হবে যে পরবর্তী সম্প্রদায় আমাদের কবরও খুঁজে পাবে না। তাই মুমিনদের উচিত, সর্বপ্রকার গর্ব-অহংকার, অন্যায়-অবিচার, পাপাচার ইত্যাদি অপকর্ম বর্জন করে স্বীয় প্রভুর নির্দেশমতো পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জীবন লাভ করা এবং আখেরাতের সুখ-শান্তি কামনা করা।
মৃত্যুর পর অনন্তকাল কবরে থাকতে হবে। এর কিয়াতম হবে। হাশরের ময়দানে পৃথিবীর আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সকল মানুষ সেদিন উত্থিত হবে। পুনঃরুজ্জীবিত হয়ে আবার আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “বল, (হে রাসূল স.) তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করতে চাচ্ছো, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে, অতঃপর তোমরা অদৃশ্য ও দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন সেসব কর্ম, যা তোমরা করতে। (সুরা জুমুয়া আয়াত ৮) এরপর দুনিয়ার জীবনের সব কৃত কর্মের হিসাব আল্লাহর সামনে দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, “পাঠ করো তোমার আমলনামা, আজ তোমার হিসাবের জন্য তুমিই যথেষ্ট।” (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ১৪)
তাই আসুন, মৃত্যুকে সামনে রেখে জীবন পথ পাড়ি দিই। মানুষের উপকার করতে নাই পারি, ক্ষতি যেনো না করি। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে মৃত্যু ও পরকালমুখী জীবন-যাপনে কবুল করুন। (আমিন)
বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর। জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট।