সুভাষ চৌধুরী
যথাযথ সম্মান দিয়ে কাউকে সম্বোধন করাটাই প্রচলিত নিয়ম। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা সম্মান ও মর্যাদাহানি হতে পারে। তা রীতিমতো অশোভনও বটে। সুতরাং সভ্য সমাজে প্রত্যেককে সম্মানজনকভাবে সম্বোধন করা সমীচীন। আমাদের সমাজে পারিবারিক সদস্যদের শ্রেণি বয়স পরিচয় ও অবস্থান বিবেচনায় এক একজনকে এক এক রকম নামে আমরা ডেকে থাকি। এতে একের সাথে অন্যের পার্থক্য রয়েছে। সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রেও এমনটি হয়ে থাকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষককে আমরা স্যার বলে ডাকি। বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষেত্রে সালাম বিনিময় করে সম্মানের সাথে আমরা ডেকে থাকি। আর এই ডাক আমরা প্রথমে পরিবার পরে শিক্ষালয় এবং সমাজ থেকে শিখে থাকি। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। উচিতও নয়। রাষ্ট্রীয় প্রোটোকল অনুযায়ী আমরা ইওর অনার, স্যার শব্দ ব্যবহার করে থাকি। অধ:স্তন কর্মকর্তা কর্মচারিরা উর্ধতন কর্মকর্তাকে স্যার ডাকবেন এটাই আমাদের সমাজের প্রচলন। এভাবেই আমরা পরস্পরকে যথাযথ সম্মান দিয়ে থাকি।
তবে স্যার ডাকা নিয়ে নানা অঘটন ঘটে যাচ্ছে আমাদের সমাজে। স্যার না বলায় আমাদের কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তা নাখোশ হচ্ছেন। তারা ক্ষমতা দেখিয়ে শাসন করছেন। স্যার শব্দটি ইংরেজী। বহুল ব্যবহারের কারণে তা এখন বাংলাকরণ হয়ে পড়েছে। শে^তাঙ্গ প্রভুদের স্যার ডাকতেই হয়। বৃটিশ শাসকরাই আমাদের শিখিয়েছে স্যার শব্দটি। মজার ব্যাপার হলো স্যার না বললে কোনো কর্মকর্তার ভালো লাগে না। আর সেজন্যই হয়ে ওঠেন শাসকদন্ডের মতো। এ প্রসঙ্গে আমি কমপক্ষে দুটি ঘটনা তুলে ধরতে চাই।
মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার একটি বাজারে কঠোর লক ডাউনের বাঁধা নিষেধ না মেনে এক ব্যক্তি তার জুয়েলারি দোকান খুলে বসেছিলেন। দোকানে সে সময় দশজন কাস্টমার ছিল। খবর পেয়ে সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুনা লায়লা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দোকান মালিক তপন সরকারকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন। জুয়েলারি দোকান মালিক সঙ্গে সঙ্গে তা পরিশোধ করেন। এরপরও ইউএনও তাকে কিছুটা বকাঝকা করলে তপন কুমার দোষ স্বীকার করে বলেন ‘আপা এবার মাফ করে দিন। ভবিষ্যতে এমনটি আর হবে না’। এতেই ঘটলো বিপত্তি। ইউএনও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন কেনো তাকে স্যার বলা হয়নি। কেনো তাকে আপা বলা হলো। কঠোর ভাষায় বকা দিতে থাকেন তাকে। এ সময় তার হুকুমে তার সাথে থাকা আনসার সদস্যরা দোকান মালিক তপনকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সাইজ করলেন। কারণ দোকান মালিক ইউএনওকে স্যার না বলে আপা বলে স্পর্ধা ও ধৃষ্টতা দেখিয়ে মহা অপরাধ করেছেন।
আরেকটি ঘটনা সাতক্ষীরার। ১৯৮৯ সাল। কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার তখন হাতেম আলি খান। কালিগঞ্জ কলেজ ছাত্ররা একটি পিকনিকের আয়োজন করেছেন। সে সময়কার ভিপি লতিফুর রহমান বাবলু কলেজের অধ্যক্ষকে দাওয়াত দিলেন পিকনিকে থাকার জন্য। অধ্যক্ষ সম্মত হয়ে বললেন তোমরা আমাদের কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ইউএনও সাহেবকে ও দাওয়াত দাও। ছাত্ররা রাজী হয়ে আনন্দে গদগদ হয়ে চলে গেলেন ইউএনও হাতেম আলি খানের কাছে। ইউএনওর কক্ষে বেশ কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে ভিপি লতিফুর রহমান বাবলু ইউএনওকে বললেন আসসালামু আলাইকুম ভাইজান। ইউওনও তেলে বেগুনে জ¦লে উঠে বললেন ‘হু আর ইউউ?, হোয়াই ভাইজান?’। বাবলু বললেন আমি লতিফুর রহমান বাবলু। কালিগঞ্জ কলেজের ভিপি। ভিপি হয়েছো তাতে কি হয়েছে? তোমার কলেজের অধ্যক্ষকে কি বলে সম্বোধন করো? বাবলু বললেন কেনো ‘স্যার’ বলে ডাকি। ইউএনও বললেন আমি তো তোমাদের কলেজ চেয়ারম্যান। আমাকে কি বলবে? বাবলু উত্তরে বললেন, প্রয়োজনে স্যার অথবা ভাই দুটোই বলতে পারি। এখন তো ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তাকে তুমি কি বলে ডাকবে? প্রশ্ন করলেন ইউএনও। যেমনটি আপনাকে ডেকেছি স্যার অথবা ভাই এর যেকোন একটি বলে ডাকবো, উত্তর দিলেন বাবলু। ইউএনও বললেন বেয়াদব। এই একে পুলিশে দাও। মামলা হবে ওর বিরুদ্ধে। স্যার না বলে ভাই বলার অপরাধে পুলিশ সত্যিই তাকে আটকে দিল। মামলাও দিলো। একদিন হাজত বাসের পর জামিন পেলেন ভিপি লতিফুর রহমান বাবলু। াঅিভিযোগ হলো বাবলু স্যার না বলে ভাই বলে তাকে হত্যার উদ্দেশ হাত উচিয়ে মারতে এসেছিলেন। এ মামলা সাতক্ষীরা জজ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। বাদি ও বিবাদির উপস্থিতিতে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত অ্যাডভোকেট এম মনসুর আলি আদালতে শুনানির সময় বাদির কাছে জানতে চান বাবলু কত দুরে দাঁড়িয়ে আপনাকে হত্যা করতে হাত উচু করেছিল। ইউএনও বলেন সাত আট হাত হবে। আচ্ছা বলুন তো ৭/৮ হাতে কয় ফুট হয়? ইউএনও সাহেব আমতা আমতা এর জবাব দিতে ব্যর্থ হন। এ মামলা শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যায়।
হাতেম আলি খানকে নিয়ে সে সময় পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল বিস্তরভাবে। যেমন ভাই বলে ডাকো যদি দেবো গলা টিপে। এই ইউএনর রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। তার দেহে বৃটিশদের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে কিনা। কারণ তিনি স্যার না বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে বাবলুকে শায়েস্তা করতে তার বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টার মামলা দিয়েছেন। সিংগাইয়ের ঘটনাও কম যায়নি। নারী ইউএনওকে স্যার না বলে আপা বলায় তার মানহানি হয়েছে। তাই জুয়েলারি দোকান মালিক তপনকে লাঠিপেটা করে শায়েস্তা করলেন।
এই মানসিকতা বর্জন করতে হবে সরকারি কর্মকর্তাদের। প্রটোকল অনুযায়ী যার যে সম্মান পাওয়া দরকার তা পাওয়া উচিত। কিন্তু সামাজিক পর্যায়ে কোন কর্মকর্তাকে স্যার না বলে আপা কিংবা ভাই বলাতে দোষটা কোথায়। লেখক: সাবেক সভাপতি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …