কেন মুসলিরা হজ করে

একেএম রফিকুন্নবী
মুসলমানদের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তিনটি যথা ঈমান, নামাজ ও রোজা সাধারণ সব মুসলমানের জন্য প্রযোজ্য। হজ এবং জাকাত শুধুমাত্র আর্থিকভাবে সচ্ছলদের জন্য প্রযোজ্য। আজকে আমরা আলোচনা করতে চাই হজ সম্পর্কে। জিলহজ মাসের ৯ তারিখে প্রতি বছর সারা দুনিয়ার মুসলমান হজ পালন করার জন্য সৌদি আরবের মক্কায় গমন করেন। পবিত্র কা’বা শরীফসহ মিনা, মুজদালিফা, আরাফাত ময়দান, কঙ্কর মারার স্থানসহ নির্দিষ্ট জায়গা সফর করতে হয়।
হজ মূলত ৯ জিলহজ তারিখে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাকেই বোঝায়। আরাফাত ময়দানে অবস্থিত নিমেরী মসজিদে জোহর-আসর একসাথে পড়তে হয়। সূর্য ডোবার আগ মুহূর্তে আরাফাত ময়দান ত্যাগ করে মুজদালিফা এসে উন্মুক্ত ময়দানে মাগরিব-এশা একসাথে পড়তে হয়। এখানেও বাথরুমের কোনো অসুবধিা নেই। এসব কাজ যথানিয়মে করার সুযোগ বিদ্যমান। এই জামাতে স্বাভাবিক সময়ে কমবেশি ২৫ লাখ লোক অংশগ্রহণ করেন। পূর্বের মরুভূমি বর্তমানে নিমগাছ-ঘেরা একটি বৃহৎ বাগান সমতুল্য। এ নিমগাছগুলো বাংলাদেশের উপহার হিসেবে সৌদি আরবে দেয়া হয়। আমরা যখন ১৯৯০ সালে হজ করতে গিয়েছিলাম, আল্লাহর রহমতে সেখানে গোটা দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী পুরুষ-মহিলা একসঙ্গে পর্দা মেইনটেন করে সারা দিন হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করার সুযোগ হয়েছিল এবং বাংলাদেশের মূল নেতার নেতৃত্বে আবেগময় পরিবেশে মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করার সুযোগ হয়েছিল, আলহামদুলিল্লাহ। হজ উপলক্ষে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আন্দোলনের কর্মীদের মিলমেলার আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ হয়েছিল আল্লাহর মেহেরবাণীতে।
হজের ব্যাপারে আল্লাহ পাক ‘আল্লাহকে খুশি করার জন্য যখন তোমরা নিয়ত করো, তখন তা পূরণ করো। কিন্তু কোথাও যদি তোমরা ঘেরাও হয়ে পড়, তাহলে সে কুরবানির নির্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছা পর্যন্ত মাথা কামাবে না। কিন্তু অসুস্থ বা মাথায় কোনো অসুখ থাকার কারণে যে ব্যক্তি তার মাথার চুল কেটে ফেলেছে, তার উচিত যেন ফিদইয়া হিসেবে রোজা রাখে বা সদকা দেয় অথবা কুরবানি করে। এরপর যদি নিরাপদ অবস্থা ফিরে আসে, তাহলে তোমাদের মধ্যে যে হজের সময় আসা পর্যন্ত ওমরাহ করার ফায়দা নেয়। সে যেন হজের সময় তিনটি রোজা এবং বাড়িতে ফিরে গিয়ে ৭টি রোজা রাখে। এভাবে যেন সে ১০টি রোজা পূর্ণ করে। এ সুবিধাটুকু তাদের জন্য, যাদের বাড়িঘর মসজিদে হারামের কাছে নয়। আল্লাহর এসব হুকুম অমান্য করা থেকে বেঁচে থাকো এবং ভালো করে জেনে রাখো, আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।’ Ñবাকারা : ১৯৬।
আল্লাহ বলেন, ‘আর আপনি সকল মানুষকে হজের জন্য ডাক দিন। তারা দূরদূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে ও উটে চড়ে আসবে।’ Ñআল হজ : ২৭। আল্লাহ আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে গণ্য। তাই যে আল্লাহর ঘরের হজ বা ওমরাহ করে, তাদের জন্য এ দুটি পাহাড়ের মাঝখানে দৌড়ানো কোনো গুনাহের কাজ নয়। আর যে নিজের মর্জি ও অনুগ্রহে ভালো কাজ করবে, আল্লাহর তা জানা আছে এবং তিনি এর মূল্য দেবেন।’ Ñবাকারা : ১৫৮।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো ও মসজিদে হারামের খেদমত করাকে ঐ লোকের কাজের সমান মনে করে নিয়েছ, যে ঈমান এনেছে আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর এবং যে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেছে, আল্লাহর কাছে তো এরা দুজন সমান নয়। আল্লাহ জালিম কওমকে হিদায়েত করেন না।’ তাওবা : ১৯। ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছে না এদের গোশত ও রক্ত, বরং তার নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ Ñসূরা হজ : ৩৭।
হজ সম্পর্কে আল্লাহর নবী সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি এ ঘরে হজ করতে এলো, অতঃপর স্ত্রী মেলামেশা করল না, কোনো প্রকার অশ্লীলতায় নিমজ্জিত হয়নি, তাহলে সেখান থেকে ফিরে আসে, যেমন নিষ্পাপ অবস্থায় তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিল।’ Ñবুখারি, মুসলিম। আল্লাহর নবী সা. আরো বলেন, হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। অতএব তোমরা হজ করো। অতঃপর এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল সা.! প্রতি বছরই কি হজ পালন করতে হবে? এভাবে তিনবার প্রশ্ন করার পর আল্লাহর নবী বলেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে প্রতি বছর হজ পালন আবশ্যক হয়ে যেত; যা তোমরা পালন করতে সক্ষম হতে না। আল্লাহর নবী সা. আরো বলেন, আমি তোমাদের যা বলি, তা আমার ওপর ছেড়ে দাও। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীগণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে অধিক প্রশ্ন করার কারণে এবং তাদের নবীদের সাথে মতপার্থক্য করার কারণে। অতএব আমি যখন তোমাদের কোনো বিষয়ে নির্দেশনা দিই, তা তোমরা সাধ্যমতো পালন করো। আর যখন কোনো বিষয়ের ব্যাপারে নিষেধ করি, তা তোমরা বর্জন করো। Ñমুসলিম।
আল্লাহর নবী সা. বলেছেন, কোনো মহিলা তার সাথে মুহরেম ছাড়া সফরে না যায়। এটা ৩ বার বলেছেন। এভাবে কুরআন ও হাদীসে হজের ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালা এবং তার প্রিয় শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে হজ পালনের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। মূলত ইবরাহীম আ.-এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম কা’বাকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ তায়ালা হজ প্রবর্তন করেন। নবম হিজরীতে উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর হজ ফরজ হয়। শরীয়তের বিধান মোতাবেক প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষ সবার ওপর জীবনে একবার হজ ফরজ। হজ ফরজ হওয়ার শর্ত নিম্নরূপÑ ১. সুস্থ মস্তিষ্ক হওয়া, ২. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, ৩. স্বাধীন হওয়া, ৪. যাতায়াত ও মক্কায় অবস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ থাকা, ৫. যাতায়াতের রাস্তা নিরাপদ হওয়া এবং ৬. মহিলাদের জন্য স্বামী অথবা কোনো নিকটাত্মীয় সফরসঙ্গী থাকা, যার সাথে বিবাহ হারাম।
হজের অন্যতম আনুষ্ঠানিকতা কুরবানি করা। যারা হজে থাকবেন, তাদের কুরবানি হজের পরের দিন। হাজীদের কুরবানি সরকারিভাবে টাকা জমা দিয়ে করা যায়। আবার নিজেরাও কুরবানি করা যায়, তবে সরকারিভাবে কুরবানি দেয়ায়ই সুবিধা। আগের দিনে কুরবানির গোশত শুকিয়ে স্বল্প পরিমাণ হলেও দেশে নিয়ে আসা যেত। এখনকার দিনে সেই সুযোগ আর নেই।
যারা হজে যাবেন না, দেশেই তাদের যার যার কুরবানি দিতে হবে। কুরবানি একজনের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে দেয়া যায়। আবার উট, গরু, মহিষ সাত ভাগেও আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানি দেয়া যায়। দুম্বা, ছাগল একজনের নামেই দিতে হবে। সৌদি আরবে যেসব কুরবানি হয়, সেগুলো ফেলে না দিয়ে বর্তমানে কুরবানির পশুর চামড়া ছড়িয়ে বরফ আচ্ছাদিত করে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এটা একটা উত্তম কাজ।
জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন নিয়ামতে ভরপুর। জিলহজের প্রথম দিন থেকেই তাকবির পড়া ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ খুবই সওয়াবের কাজ। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা. জিলহজ মাসের ১ তারিখ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত রোজা রাখার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। জিলহজের প্রথম দশ দিনের ইবাদতের চেয়ে দুনিয়ার অন্য কোনো দিনের ইবাদত মহান আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় নয়। এই ক’দিনের মধ্যকার এক দিনের রোজা এক বছর রোজা রাখার সমান এবং তার একটি রাত কদরের রাতের সমান। Ñতিরমিযী ও ইবনে মাজা। আরাফাতের দিনে সারা দুনিয়ার মানুষকে রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন এবং খুবই মর্যাদাকর বলে উল্লেখ করেছেন। নফল রোজা যেহেতু একটা করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, তাই আরাফাতের আগের দিন অথবা পরের দিন যোগ করে দুদিন রোজা রাখা ভালো। জিলহজ মাসের প্রথমাংশে হজ, কুরবানি, রোজা রাখার সাথে সাথে দান-খয়রাত করা, বেশি বেশি নফল ইবাদত করা খুবই সাওয়াবের কাজ। আমরা যারা সক্ষম, তাদের ৯টি রোজা রাখা উত্তম।
অদৃশ্য মহামারি করোনায় গোটা দুনিয়া স্থবির হয়ে পড়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের পাপের কারণে যুগে যুগে পরীক্ষা করার জন্য এ-জাতীয় মহামারি দিয়ে থাকেন। আমাদের ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ফিরে আসাই মানুষের কল্যাণ। মহামারি করোনার কারণে এবারে সৌদি আরবে সরকার বিদেশিদের হজ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। শুধু সৌদি আরবে বসবাসরত মাত্র ৬০ হাজার মুসলমান এবার হজ করতে পারবেন। মুসলমানদের জন্য এটা খুবই বেদনাদায়ক এবং অমর্যাদাকর। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ মহামারি থেকে উত্তীর্ণ করে তাঁর নির্দেশ পালন করার তাওফিক দান করুন।
পূর্ব জমানায় হজ করা খুবই দুঃসাধ্য ছিল। মাসের পর মাস পায়ে হেঁটে হজ পালন করতে হতো। পরবর্তী সময়ে নৌপথে জাহাজে করে হজ পালন করতে হতো। বর্তমানে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সারা দুনিয়া থেকে মানুষ সৌদি আরবে হজ করার জন্য পৌঁছতে পারে। সৌদি সরকার জেদ্দায় এয়ারপোর্টকে বিশ্বমানের বৃহদাকার করেছেন। ফলে গোটা দুনিয়ার বিমানগুলো ওঠানামায় কোনো অসুবিধা হয় না। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে বিমানগুলোয়ও অজু, জামাতে নামাজ, চা-কফি থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়ার সব ব্যবস্থাই আছে। তাই আর্থিকভাবে সচ্ছল-সুস্থ মানুষের হজ করাটা অতীব জরুরি এবং উত্তম কাজ। হজে গেলে মদীনায় আল্লাহর রাসূল সা.-এর কবর জিয়ারত করার একটা বড় সুযোগ পাওয়া যায়। মদীনায় মসজিদটি বর্তমানে একদিকে বৃহদাকার; অন্যদিকে সুযোগ-সুবিধাও প্রচুর। সারা শহর থেকে মদীনার মসজিদে পৌঁছার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে সোজা ওপরে উঠে নামাজে শরিক হওয়া যায়। মসজিদে নববীতে পুরুষ-মহিলা পৃথকভাবে জামাত আদায়ের সুযোগ রয়েছে। চত্বরের নিচে অজু-গোসলের জন্য পর্যাপ্ত বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। তাই আবার বলতে চাইÑ সচ্ছল-সুস্থ ব্যক্তি পুরুষ-মহিলাকে অবশ্যই হজ পালনের সাথে সাথে মদীনায় আল্লাহর নবীর সা. কবর জিয়ারতসহ আশপাশে অসংখ্য শহীদের কবর জিয়ারতে শরিক হওয়ার জন্য। জিলহজ মাসের প্রথম দিন থেকে ১৩তম দিনের আসর পর্যন্ত তাকবির প্রতিনিয়ত; বিশেষ করে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পড়া অতি উত্তম।
আমরা বাংলাদেশিদের জন্য অনেক উৎসাহী ভাইয়েরা হজ ও ওমরাহ পালনের সুবিধার্থে হজ কাফেলার আয়োজন করে থাকি। ২০১৯ সালে এরকম একটি হজ কাফেলার সাথে ওমরাহ করার সুযোগ হয়েছিল, আলহামদুলিল্লাহ। অভিজ্ঞ হজ কাফেলা খুঁজে নিতে পারলে হজ এবং ওমরাহ পালনে খুবই সুবিধা হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের হজ এবং ওমরাহ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।