কোরবানির মহান আত্মত্যাগের দিন পবিত্র ঈদূল আজহা। ঈদ অর্থ আনন্দ বা খুশি করা আর আযহা অর্থ পশু কোরবানি করা।বিশ্বব্যপি মুসলমানদের জন্য ঈদূল আজহা একই সাথে কোরবানি দেওয়া ও উৎসব করার দিন। এদিন আসলে সামনে এসে দাড়ান মুসলমানদের আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম আঃএর নাম।আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্যের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ছিল ইব্রাহিম আঃ এর প্রিয় পুত্র কোরবানি। তিনি আল্লাহকে ভালোবাসেন ও মান্য করেন নাকি গুরুত্ব তার কাছে বেশি এটা পরিক্ষা করাই ছিল আল্লাহ তাআলার আসল উদ্দেশ্য।এজন্য ইব্রাহিম আঃ তার পুত্র ইসমাইল আঃ কে কোরবানি করার কথা সপ্নে পেয়েছেন। ইসমাইল আঃ ও স্বচিত্তে মেনে নেন আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশনাকে।যেটা দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন মহান আল্লাহ তাআলা।অতঃপর ইব্রাহিম আঃ পুত্রকে যখন শুইয়ে কোরবানি করার জন্য উদ্যত হন।গলদেশে ছুরি চালানোর ঠিক আগ মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দেন তিনি যেন ইসমাইল আঃ এর বদলে একটি পশু কোরবানি দেন।সেই থেকে পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈদ আনন্দ পালন করে থাকে সমগ্র জাহানের মুসলমানগণ।দিনটি শুধু আনন্দ আর উৎসবের নয়, আল্লাহ তাআলার প্রতি পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও আনুগত্য তৈরি করা এবং স্বার্থচিন্তার উচ্ছেদ করে আত্মত্যাগের শিক্ষা দেওয়া।যার মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশে ত্যাগের মহিমায় মুমিনদের মন অনাবিল প্রশান্তি ও আনন্দে ভরে ওঠে।সুতরাং কেবল পশু কোরবানি দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার পরিবর্তে মুসলমানদের উচিত নিজেকে আল্লাহ তাআলার কাছে সম্পূর্ণরুপে প্রতিষ্ঠিত করা। এজন্যই কবি নজরুল তার কবিতায় বলেন,
ওরে হত্যা নয় আজ’সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
দুর্বল ভীরু! চুপ রহো,ওহো খামকা ক্ষুদ্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রনি দূরবাণীর,
আজিকার এ কোরবানির!
দুম্বা-শীর রুমবাসীর
শহীদের শীর সেরা আজি!রহমান কি রুদ্র নন?
বাস চুপ খামোস রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর,খুন দে,জান দে,শির দে,ব স শোন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’,শক্তির উদ্বোধন।
এবারের ঈদ এমন সময় উদযাপিত হতে যাচ্ছে যখন সারা বিশ্ব করোনা মহামারিতে আক্রান্ত। প্রতিদিন হাজার মানুষ পৃথিবীকে বিদায় জানাচ্ছে অদৃশ্য এই শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়।যদিও ঈদ আমাদের দেশে বরাবরই ব্যপক আয়োজন, উদ্দীপনা ও উৎসবমুখরতার ভিতর দিয়ে পালিত হয়।কিন্তু এবার ব্যতয় ঘটেছে।
আবার ঈদকে ঘিরে প্রতিবছর সকল পন্য সামগ্রি, পোশাক পরিচ্ছেদ,আধুনিক ও ঐতিহাসিক সাজসজ্জা, বিনোদন,নবরত মনিহারি আঙ্গিকে সাজানোর অন্তরকণ প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলে।কিন্তু এবার ঈদ পূর্ববর্তী লকডাউন থাকায় অনেক কিছু অসম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে ছিন্নমূল কর্মজীবীরা পড়েছে বিপদে।
কয়েকটি জরিপ থেকে জানা গেছে করোণাকালীন বছরে কর্মহীনতার আহাকারে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বিপর্যস্ত।
ILO এর মত অনুসারে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে ২০২০ সালে ৮.১০কোটি চাকরিহীন হয়েছেন।অপরদিকে ফোর্বস এর তথ্য মতে একই সময়ে সম্পাদের পরিমাণ বেড়ে একই সময়ে বর্তমান বিশ্বে বিলিয়নার হয়েছেন ২৭৫৫ জন।যাদের মোট সম্পদ ১৩.১০ লক্ষ মার্কিন ডলার। বৈশ্বিক দারিদ্রের সাথে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে খাদ্য সংকট ও পণ্য মূল্যের উর্ধগতি। করোণা সংকট শুরুর পূর্ব থেকে বিশ্বায়ন প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারে কর্মহারা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি চলমান করোনাকালীন লকডাউন ও অন্যান্য কারণে অধিকতর দীর্ঘায়িত হয়েছে।গণমাধ্যমে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সূত্র মতে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রযুক্তির কারণে ৮০ কোটি মানুষ কর্মহীনতায় পড়বে।নাগরিক প্লাটফর্ম জরিপের মতে, করোণার কারণে দেশের ৮০ শতাংশ পরিবার খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন এবং ৬০.৫ শতাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়েছে যাদের অধিকাংশ শ্রমিক। দরিদ্রতার হার৪২ শতাংশে দাড়িয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ব্যংকের তথ্যানুসারে করোণা মহামারির একবছরে ব্যংকে কোটিপতির সংখ্যা ১০ হাজার ৫১ জন।বিগত বছর শেষে কোটিপতিদের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৮৩৮৯০ টি।দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে বলে গবেষণায় প্রকাশিত। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, অর্থনীতিবীদদের মত,শুধুমাত্র লকডাউন এ মোট কর্মগোষ্ঠির ৫৯ শতাংশ লোক কর্মহীন হয়েছে। সূত্র (মে,জনকণ্ঠ)।
উপরোক্ত আলোচিত বিষয়ের সারসংক্ষেপ হিসাবে বলা যায়, করোনা বিস্তারে প্রাণ সংহারের বিপরীতে চলমান ঈদ কোনভাবেই জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠবে না।ভয়ংকর এই অদৃশ্য শক্তির সাথে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ব্রত গ্রহন করে ঈদের আয়োজনকে সীমিত পরিসরে উপভোগ করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্বৃত সকল নেতিবাচক সংকট উত্তরণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনোবল সর্বদা শক্তিমানতায় ঋদ্ধ। এবারের ঈদে আমাদের প্রার্থনা হোক করোনা যেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।তাহলে হয়তো মানুষ প্রশান্তির নদীতে ঝাপ দিতে পারবে।
যদিও এ ভাইরাস পৃথিবী থেকে কবে বিদায় নেবে আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন।তবুও সব আধার এক সময় ফুরায়।গহীন অরণ্যের শেষ প্রান্তে এক চিলতে আলো দেখবার প্রত্যাশা থাকে পথ খুজে বেড়ানো মানুষদের।অবসাদ, মানসিক চাপ কাটিয়ে পৃথিবীর মানুষ ফিরে আসুক জীবনে। শহর ফিরুক তার নিজস্ব ছন্দে।প্রকৃতি ফিরুক তার নিজের নিয়মে। কোরবানি আসে হিংসা বিদ্বেষ ও অন্তর্নিহিত পশুত্বকে জবাই করার মহান প্রেরণাকে নিয়ে এবং আল্লাহ প্রতি আনুগত্যের পারকাষ্ট প্রদর্শনের জন্য।সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত করে সাম্য ও মৈত্রী। কোরবানির মহত্ত্ব বোঝার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত।তাই কোরবানি মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা পশুত্ব তথা মনুষ্যহীনতাকে ধংষ করে দিক।সকল মানবিক দুর্বিপাক,কষ্ট ও মূল্যবোধের প্রতি সহানুভূতি সংহত হোক।মানুষের মধ্যে ইসলামের অহিংসা,ক্ষমা সৌন্দর্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা জাগ্রত হোক। আমাদের জাতীয় জীবনে যাবতীয় অন্যায় ও অসদাচরণ দূর করে দিক… করোনাকালে এটাই প্রত্যাশা।
মোঃ রাসেল হোসেন, অনলাইন সংবাদকর্মী,যশোর।