এই যুদ্ধের সূচনা ২০০১ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের আল-কায়েদার হামলাকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ শুরু। যুক্তরাষ্ট্র তখন বলেছিল, তারা পশ্চিমা অন্য দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসবাদের মূল উৎপাটন করবে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, এই লক্ষ্যে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর তালেবান ও আল-কায়েদার স্থাপনা লক্ষ্য করে কাবুল, কান্দাহার ও জালালাবাদে প্রথম বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এরপর ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর তালেবান সরকারের পতন হয়।
কিন্তু পশ্চিমা বাহিনীগুলোর জন্য মূল চ্যালেঞ্জটা শুরু হয় এরপর। ইংরেজি ভাষার এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য অনুসারে, সরকার পতনের পর তালেবানের উত্থানের নতুন সূচনা হয়েছিল ২০০৫ সালের দিকে। ওই সময় থেকে তারা আত্মঘাতী হামলা চালানো শুরু করে। এই হামলা ঠেকাতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিতে হয় পশ্চিমা বাহিনীগুলোকে।
এসব হামলা ঠেকাতে আফগানিস্তানের ন্যাশনাল আর্মি ও পুলিশ বাহিনী গঠন করতে হয়। এই বাহিনী গঠনে কাজ করে পশ্চিমা বাহিনীগুলো। আর এ জন্য খরচ হয় প্রায় ৯ হাজার কোটি ডলার। এ ছাড়া সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে পশ্চিমা বাহিনীগুলোকে আলাদাভাবেও অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খাবার, পোশাক, চিকিৎসাসেবা। হামলা ঠেকানো ও এ–সংক্রান্ত তথ্য পেতে বিশেষ প্রণোদনাও দিতে হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোকে।
আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নেও অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। দেশটির সরকারি হিসাব অনুসারে, ২০০২ সাল থেকে কাঠামো পুনর্নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি ডলার। এ ছাড়া আফগান সরকার পরিচালনার জন্যও অর্থ দিতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। এ জন্য সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে।
তবে এর মধ্যেও কিছু অর্থ জলে গেছে। কিছু অর্থ ধাপ্পাবাজদের হাতে গেছে। এ নিয়ে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়, অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার নষ্ট হয়েছে।
বিবিসির দেওয়া তথ্য অনুসারে, আফগানিস্তানে যুদ্ধে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তার অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি ছিল। এই সময় এক লাখের বেশি মার্কিন সেনা সেখানে ছিল। তখন প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি ব্যয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তবে পরে এই খরচ কমাতে সক্ষম হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তালেবানবিরোধী অভিযান এবং আফগানিস্তানের বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা থেকে সরে আসে দেশটি। এতে মার্কিন সরকারের খরচ কমে যায়। এ প্রসঙ্গে গত বছর মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের এক কর্মকর্তা কংগ্রেসকে জানান, ২০১৮ সাল নাগাদ আফগানিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় নেমে আসে সাড়ে চার হাজার ডলারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ব্যয় ৭৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরই শুধু একা আফগানিস্তানে অর্থ ব্যয় করেছে এমনটা নয়। বিবিসি বলছে, পেন্টাগন ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি এবং সরকারের অন্যান্য এজেন্সি আফগানিস্তানে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করে সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ সব মিলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যয় হয় ৮২ হাজার কোটির বেশি মার্কিন ডলার।
তালেবান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের যে শুধু আফগানিস্তানে অর্থ ব্যয় হয়েছে এমনটা নয়। মার্কিন সরকারকে পাকিস্তানেও অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। কারণ, আফগানিস্তানে অভিযান চালানোর জন্য পাকিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে দেশটি। কিন্তু সেই খরচ এসব হিসাবের মধ্যে নেই। এ নিয়ে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই গবেষণায় এটাও বলা হয়েছিল, ঠিক নিশ্চিত করে এই অর্থের পরিমাণ বলা কঠিন। কারণ, সময়ের ব্যবধানে এটা পরিবর্তন হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরই আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি সেনা ছিল যুক্তরাজ্য ও জার্মানির। এই যুদ্ধে যুক্তরাজ্য ব্যয় করেছে ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আর জার্মানির ব্যয় ১ হাজার ৯০০ মার্কিন ডলার। আর ন্যাটোর পক্ষ থেকে এই যুদ্ধকালে বিভিন্ন সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে। যার মূল্য ৭ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার।
কিন্তু ব্যয় এখানেই শেষ হচ্ছে না। আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের সেনাদের খরচ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো। ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। তবে এই অর্থ আর কাজে আসবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ তো গেল অর্থ খরচ। এই যুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে। মরেছে ব্রিটিশ সেনাও। মরেছে আফগানিস্তানের সেনা ও বেসামরিক নাগরিকও।
অর্থ গেল, মানুষের জীবন গেল। কিন্তু শান্তি এল না আফগানিস্তানে। অন্তত তালেবান দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। আর শিগগিরই যে শান্তি আসছে না, তারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, তালেবানরা রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেখানে বেশ কিছু ঘরবাড়িতে লুটপাট শুরু হয়েছে। কাবুল বিমানবন্দরে এর মধ্যেই পাঁচজন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স। দেশ ছাড়তে বিমানে উঠতে হুড়োহুড়িও পড়ে গেছে। যদিও তালেবান দাবি করছে, মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর তাদের কোনো লোভ নেই।