বাংলাদেশের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে সহসাই আলোচনার কোন সম্ভবনা দেখছেন না।
মিয়ানমারে সেনা শাসন আসার পর থেকে ছয় মাস ধরে দেশটির সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের আলোচনা বন্ধ হয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিবিসিকে বলেছেন, বাংলাদেশ এই ইস্যুতে যতটা এগিয়েছিল, সেটা মিয়ানমারের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে থমকে গেছে।
তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এখন মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর জন্য আগামী মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইস্যুটি উত্থাপন করবে।
তবে মি: আলম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশের সীমান্তে আসতে শুরু করেছিল ২০১৭ সালের ২৫শে অগাষ্ট । এর চার বছর পুরো হল আজ বুধবার।
সে সময় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
আরও পড়ুন:
মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে আলোচনা বন্ধ
লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় আশ্রয় নেয়ার পর চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।
যদিও মিয়ানমারে অং সান সু চি’র সরকারের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ চুক্তি সই করেছিল।
চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারের সেই সরকারেও গড়িমসি ছিল। তখন চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চলছিল।
কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনাশাসন আসার পর সেই আলোচনাও বন্ধ হয়ে যায়।
সহসাই আলোচনার সম্ভবনা দেখছে না বাংলাদেশ
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আলোচনা শুরুর ব্যাপারে মিয়ানমারের সামরিক সরকার থেকে কোন ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না।
“আমরা যতটুকু এগিয়েছিলাম, সেটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে থমকে গেছে” বলেন তিনি।
তবে এর আগে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারের সময় আলোচনা বা চুক্তি হলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যে শুরু করা যায়নি- সে প্রসঙ্গও তিনি উল্লেখ করেছেন।
তিনি অবশ্য মনে করেন, প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও তখন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকার একটা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দায়বদ্ধ ছিল।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে অভিযোগ যে আন্তজার্তিক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, সেই আদালতে শুনানিতে মিয়ানমারের আগের গণতান্ত্রিক সরকারের নিয়মিত অংশ নেয়ার বিষয়কেও উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
সেই প্রেক্ষাপটে তিনি মনে করেন, তখন মিয়ানমারের আগের সরকারের ওপর একটা চাপ তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল।
“কিন্তু মিয়ানমারের বর্তমান সেনা শাসিত সরকার যদিও অভ্যন্তরীণভাবে বলেছে যে, রোহিঙ্গা বা অন্যান্য সমস্যার সমাধান তারা করতে চায়। কিন্তু কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ বা পদক্ষেপ আমরা তাদের দিক থেকে পাইনি,” বলেন শাহরিয়ার আলম।
আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর তাগিদ
মিয়ানমারে সামরিক সরকার যতদিন থাকবে, ততদিন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দ্বিপাক্ষিকভাবে কোন পদক্ষেপ নেয়া কতটা সম্ভব হবে- বাংলাদেশ সরকারের ভেতরে এমন সন্দেহও কাজ করছে বলে মনে হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে, সেজন্য দেশটির সামরিক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর ভরসা করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
তিনি বলেছেন, “একটা ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, আমেরিকা এখন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাতে কিন্তু বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা রাষ্ট্র।
“কিন্তু সেটার প্রতিফলন এখনও দেখা যাচ্ছে না। সেজন্য বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও সক্রিয় হতে হবে,” মনে করছেন অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অবশ্য বলেছেন, জাতিসংঘে আগামী মাসের সাধারণ পরিষদের অধিবশেনে তারা বিষয়টা তুলবেন।
“রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম সারির অগ্রাধিকার ইস্যু হিসাবে আমরা এখনও রাখতে পেরেছি। যেকোন আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনায় বিষয়টা আসে এবং সামনে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেও আলোচনায় আসবে,” বলেন মি: আলম।
জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন
একইসাথে অবশ্য মি. আলম অভিযোগ করেছেন, জাতিসংঘ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সেভাবে ভূমিকা রাখেনি।
“জাতিসংঘ দুর্ভগ্যজনকভাবে শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের দেখভাল করার ক্ষেত্রেই ইউএনএইচসিআর এবং আইওএম এর সাথে কাজ করছে।
“জাতিসংঘ এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভাল ভূমিকা রাখতে পারেনি। সামনের দিনে রাখতে পারবে বলেও আমরা খুব একটা আশাবাদী নই,” বলছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
এমন পরিস্থিতিতে চীন এবং অন্যদিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের ওপর বাংলাদেশের নির্ভর করার কথাও তিনি তুলে ধরেন।
“আমরা এখন আসিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছি। এখানে আঞ্চলিক এবং আমাদের ও মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।”
এদিকে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআর এক লিখিত বক্তব্যে বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যাতে মিয়ানমারে নাগরিক হিসাবে নিরাপত্তাাসহ সব অধিকার নিয়ে ফিরে যেতে পারে, সেই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাজ করছে।
রোহিঙ্গারা কী বলছেন?
চার বছর আগে ২০১৭ সালের ২৫শে অগাস্ট মিয়ানমারে নির্যাতনের কারণে টেকনাফ এবং উখিয়ার সীমান্তে রোহিঙ্গাদের যে ঢল নেমেছিল, রোহিঙ্গাদের সেই স্রোতে ছিলেন রোজিনা বেগম।
পাঁচ শিশু সন্তান এবং স্বামী সহ তিনি এখন উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন।
রোজিনা বেগম বলেছেন, অধিকার নিয়ে নিজের দেশে অদূর ভবিষ্যতেও ফেরত যাওয়া সম্ভব হবে কিনা-এই প্রশ্নে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।