সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের নরহরকাটিতে বসবাসরত ৪০টি ভূমিহীন পরিবারের সম্মিলিত মাছের ঘের জবরদখলের অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর বিরুদ্ধে। থানায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না ওইসব ভূমিহীনরা।
নরহরকাটি গ্রামের আরিজুল্লাহ শেখের ছেলে ভূমিহীন শওকত আলী জানান, উপজেলার নরহরকাটি মৌজার ৫০ বিঘা অর্পিত সম্পত্তির মধ্যে ৩৭ বিঘা জমিতে ১৯৭৮ সাল থেকে তিনিসহ ৪০টি ভূমিহীন পরিবার বসবাস ও যৌথভাবে মাছ চাষ করে আসছেন।
দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের আব্দুর রহমান ওই জমি নীলকান্ত ঘোষ এর সাথে অনিবন্ধিত বিনিময় দলিল মূলে দাবি করলেও তা বৈধতা না পাওয়ায় পরবর্তীতে ‘খ’ তপশীলভুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর ‘খ’ তপশিল বাতিল করা হয়। ওই জমি হাজী আব্দুর রহমান নিজে মোতাল্লি হয়ে আব্দুর রহমান স্টেটের নামে দাবি করে একাংশ দখল করতেন।
বর্তমানে ওই এস্টেটের মোতাল্লি হিসেবে মোবারক আলীর ছেলে আনোয়ারুল ইসলাম দাবি করে ভূমিহীনদের দীর্ঘদিনের দখলে থাকা জমি দখলের চেষ্টা করে আসছিলেন। খুলনা জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে আনোয়ারুল ইসলামের ৪১/১২ মিস আপিল মামলায় ওই জমি সরকারি খাস সম্পত্তি হিসেবে বহাল থাকে। এরপরও দেওয়ানী মামলা ও ভূমি আপিল বোর্ডের মামলায় জমি নিজেদের প্রমান করতে ব্যর্থ হয়ে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে আনোয়ারুল ইসলাম ও তাদের সহযোগীরা।
একপর্যায়ে আনোয়ারুল ইসলামের বাবা মোবারক আলী সরকারের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা যুগ্ম জেলা জজ ২য় আদালতে ২৪/২০১০ মামলা করে নিষেধাজ্ঞা না পেয়ে ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ১৮০৩/২০১৩ দেওয়ানী রিভিশন মামলা করে এ পর্যন্ত কয়েকবার অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নেন। ওই মামলার ৯নং বিবাদী আব্দুল হামিদ মারা গেলেও তিন নং বিবাদী কেরামত আলী ওরফে কেনা পক্ষভূক্ত হয়েছেন। হাইকোর্টে মামলা থাকায় বার বার আবেদন করেও ডিসিআর পায়নি ভূমিহীনরা।
এদিকে পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে গত বছরের ২৬ নভেম্বর আনোয়ারুল ইসলাম ওই জমি ‘খ’ তপশীলভুক্ত করে অর্পিত সম্পত্তির হোল্ডিং খুলে ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণ করার আদেশ পাওয়ার চেষ্টা করেন। মৌতলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশীলদার অসীম কুমার হালদার গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ওই জমির একাংশে বেশ কয়েকটি ভূমিহীন পরিবার বসবাস করে ও সেখানে যৌথভাবে মাছ চাষসহ চাষাবাদ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। ফলে আনারুলের আবেদন মঞ্জুর হয়নি।
একপর্যায়ে ৪৩ বছর ধরে ওই জমিতে বসবাসরত ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করতে মরিয়া হয়ে উঠলে তিনি বাদি হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা (পিটিশন- ৩৪৮/২১ নং) দায়ের করেন। এ খবর পেয়ে গত ৮ জানুয়ারি ভূমিহীন আবুল হোসেনের বসত বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় আবুল হোসেন বাদি হয়ে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি আনোয়ারুল ইসলামসহ ১৪জনকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলা থেকে বাঁচতে আনোয়ারুলের সহযোগি শফিকুল ইসলাম ১১ জানুয়ারি ১৫জন ভূমিহীনের নামে থানায় ঘেরের বাসায় আগুন দেওয়ার ঘটনার মিথ্যা মামলা দায়ের করে।
এর আগে ওই জায়গা থেকে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করতে প্রভাবশালী আনোয়ারুল তার সহযোগী শহীদুলকে দিয়ে গত বছরের ১৫ নভেম্বর ১৬জন ভূমিহীনের নামে ১০৭ ধারার মিথ্যা মামলা করে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে। এ ছাড়া আনোয়ারুল বাদি হয়ে গত বছরের ২৮ মার্চ তিন লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে ঘেরে বিষ দিয়ে মাছ মেরে ফেলে সালাউদ্দিনসহ ৮জন ভূমিহীনের নামে মিথ্যা জিআর ৭৭/২০ নং মামলা করেন।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর পুরুষরা বাড়িতে না থাকার সূযোগে আানায়ারুলের নেতৃত্বে ৬০/৬৫ জন সন্ত্রাসী ভূমিহীন জনপদে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে রহিমা, শামীমা, আয়েশা ও পাপু বেগমকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করে উল্টে থানায় ১২ জন ভূমিহীনদের নামে গত বছরের পহেলা অক্টোবর মিথ্যা মামলা করে।
একইভাবে চাঁদা দাবিতে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর বাই সাইকেল কেড়ে নিয়ে মারপিটের অভিযোগ এনে আনোয়ারুল তার ভগ্নিপতি জিএম ফজলুর রহমানকে দিয়ে ৫জন ভূমিহীনের নামে মিথ্যা মামলা করান।
আবুল হোসেনের বাড়িতে আগুন দিয়েও সুবিধা করতে না পারায় আনোয়ারুল ইসলাম ওই ৫০ বিঘা জমির মধ্যে ৪০ বিঘা জমি তার দখলে আছে দাবি করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এলাকার মাজাহারুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, হবিবর রহমান ও আকবর আলীর কাছে লিজ দিয়েছেন বলে ভূমিহীনরা জানতে পারে।
চলতি বছরের পহেলা মার্চ লীজ গ্রহীতারা ভূমিহীনদের জমি দখল করার লক্ষ্যে ওই জমির পাশে কাটা তার ও বাঁশ জমায়েত করে। বাধ্য হয়ে ভূমিহীনদের পক্ষ থেকে আদালতে ১৪৫ ধারার মামলা করা হয়।
স্থানীয় ভূমিহীনরা জানান, ভূমিহীনদের জমি লীজ গ্রহীতারা দখল করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে আসছিল। এরই একপর্যায়ে গত ২১ আগষ্ট সকাল সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী, তার ছেলে ছাত্রলীগ কর্মী নাহিদ মেহেদী অনিক ও কুলিয়া দুর্গাপুরের সাজেদুল হক সাজুর নেতৃত্বে ৩০/৩৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী বোমা মেরে ত্রাস সৃষ্টি করে পাকা পিলার ও কাটা তারের বেড়া দিয়া তাদের জমি জবরদখরের চেষ্টা করলে বাধা দেওয়া হয়।
একপর্যায়ে তারা চলে যাওয়ার পর তিনি সাঈদ মেহেদী ও তার ছেলেসহ কয়েকজন সন্ত্রাসীর নাম উল্লেখ করে ওই দিন বিকেলে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ কোন ভূমিকা না রাখায় বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে কৃষ্ণনগরের সাঈদ মেহেদী ও অনিক মেহেদীর নেতৃত্বে নুরুল গাজী, রেজাউল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, বানিয়াপাড়ার কেরামত গাজী, শঙ্করপুরের বাহার আলীসহ সশস্ত্র শতাধিক সন্ত্রাসী হাত রাম দা, লোহার রড, জিআই পাইপ, চাপাতিসহ ভূমিহীন জনপদে ঢুকে বোমা ফাটিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে। সন্ত্রাসীরা ভূমিহীনদের ঘেরের তিনটি বাসা দখলে নিয়ে সেখানে অস্ত্র মজুত করে।
প্রতিবাদ করায় সন্ত্রাসীরা ভূমিহীন ফরিদা খাতুন, মোসলেমা খাতুন, রঞ্জু খাতুন, আয়েশা খাতুন ও সাজেদা খ্তাুনসহ কয়েকজনের উপর হামলা চালায়। এর পর থেকে সাঈদ মেহেদী ও অনিক মেহেদীর উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীরা ভূমিহীনদের ঘেরের জমি দখলে রাখতে কাটা তার দিয়ে বেড়া নির্মাণ করে যাচ্ছে। পুলিশ সাঈদ মেহেদীর পক্ষ নিয়ে গভীর রাতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দেখা করে চলে যাচ্ছে।
জবরদখলের কাজ তদারকি করছেন কুলিয়া দুর্গাপুরের বহুল আলোহিত সাজেদুল হক সাজু। সাজু সাতক্ষীরার দু’ এমপির মাথার দাম কোটি টাকা উল্লেখ করে ফেইসবুকে স্টাটাস দেওয়ার ঘটনায় গত ১১ আগষ্ট দেবহাটার বালিয়াডাঙা গ্রাম থেকে গ্রেপ্তারকৃত ইউসুফ হোসেন বাবুর দুলাভাই। সাজুর শ্বশুর গ্রেপ্তারকৃত মনিরুল ইসলাম জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ও মাতা আজমিরা বেগম জামায়াতের মহিলা রুকন। শ্যালক ও শ্বশুর গ্রেপ্তারের পর সাজু গ্রেপ্তার আতঙ্কে কয়েকদিন আত্মগোপনে ছিলো। সাঈদ মেহেদী, অনিক ও সাজুর সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে ভূমিহীনরা গভীর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
জমির মালিকানা দাবিদার দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়ার আনারুল ইসলাম বলেন, তার দীর্ঘদিনের সম্পত্তি উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীকে লীজ দিয়েছেন। তাছাড়া ফারজানা ক্লিনিকের সামনে তার বাসা আছে। রোববার আসলে দেখা হবে।
এব্যাপারে শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে নাহিদ মেহেদী অনিকের নাম্বার মোবাইল ফোনে একাধিবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর সঙ্গে শুক্রবার দুপুর একটার দিকে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ওই জমি অর্পিত সম্পত্তি, সরকারি খাস নয়। সেখানে বসবাসকারিদের জন্য ১০ বিঘা বাদ দিয়ে তিনি জমির মালিক দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়ার আনারুল ইসলামের কাছ থেকে ৪২ বিঘা জমি লীজ নিয়েছেন। সেখানে কোন ভূমিহীন বসবাস করে না দাবি করে তিনি বলেন, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলার পর তাদের মতমত নিয়ে তিনি ওই জমি দখলের জন্য ঘেরা দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ গোলাম মোস্তফা বলেন, কোন দখল বেদখলের বিষয় তার জানা নেই। দেবহাটার নওয়াপাড়ার আনারুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির জমি নরহারকাটির কয়েকজন দখল করে রেখেছিল মর্মে তাকে জানানো হয়েছিল। এছাড়া নরহরকাটিতে কোন ধরনের বোমা হামলার ঘটনা ঘটেনি। ২১ আগষ্ট ভূমিহীন শওকত হোসেনের অভিযোগটি তার দেখা হয়নি।