আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা থেকে: জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। মনুষ্য সৃষ্টির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর নাব্যতা হ্রাস, পলিপড়ে নদীর তলদেশ ভরাট, অকেজো স্লুইস গেট, খননের নামে চরম দুর্নীর্তি ও ভারতীয় নদী আগ্রাশান এর জন্য দায়ী। ফলে ফসলের মাঠ,মৎস্য ঘেরসহ গোটা জেলার নিন্ম অঞ্চল যেন পানিতে ভাসছে। পানির প্রবাহ হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জেলার ৪২৯টি খাল। এসব খাল এখন জেলাবাসীর দু:খ বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব খালের উপর নির্মিত ২১৬টি স্লুুইস গেটের বেশির ভাগ অকেজো। ২৭টি নদীর ১৩ টি পলিপড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এসব নদী থেকে প্রবাহিত চার শতাধিক খাল তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। বেশিরভাগ খাল প্রভাবশালীদের দখলে। এসব খালে বাধ দিয়ে লোনা পানি তুলে মাছ চাষ করার অভিযোগ রয়েছে। মাত্র কয়েকটি খাল পানিউন্নয়ন বোর্ড ও জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দর্শকে এসব খালের উপর নির্মিত ২১৬টিস্লুইস গেটের মেয়াদ প্রায় শেষ।
এদিকে আন্তজার্তিক সীমানা চুক্তির অভিযোগ তুলে সাতক্ষীরা সীমান্তে বেঁড়িবাধ নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সাতক্ষীরা সদরের পশ্চিমে বৈকারি ও কুশখালি ইউনিয়ন সীমান্ত ঘেষা ৮ কি:মি: বেঁড়িবাধের নির্মাণ কাজ করছিল বাংলাদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইত্যোমধ্যে নির্মাণ কাজের আংশিক শেষ হয়েছে। বৈকারি সীমান্তের বাগধাড়ানি থেকে খইতলা হয়ে কুশখালি ছয়ঘরিয়া তলুইগাছা সীমান্তের বেঁড়িবাধ পূর্ণ নির্মাণের জন্য সরকার এক কোটি ৪০ লাখ টাকার বরাদ্ধ দেয়। নেত্রকোনার মেসার্স অসিম সিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্তাধিকারি বাবু অসীম কুমার সিং ১২টি স্কেভেটর দিয়ে বেড়িবাঁধ নিমাণের কাজ করতে থাকে। কিন্তু সীমান্তের ১৫০ গজ অভ্যন্তরে হওয়ায় আন্তজার্তিক সীমানা চুক্তির লংঘনের অভিযোগ তুলে সেই কাজ বন্ধ করে দেয় ভারতীয় বিএসএফ।
পানিউন্নয়ন বোর্ড বলছে জেলার ১৪টি নদী কোন রকমে টিকে আছে। এসব নদীর শাখা প্রশাখায় প্রবাহিত রয়েছে ৪২৯ টি খাল। পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে যার বেশির খাল এখন অস্তিত্ব হারিয়েছে। অনেক জায়গায় নদী ও খালের বুকে জেগে উঠা চরে মানুষ বসতি শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগে ২১৬টি স্লুইস গেট রয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ১২৩টি স্লুইস গেট রয়েছে। যার ৮০টি কার্যক্ষম আছে বাকি ৩৪ টি সম্পূর্ণ অকেজো।
এছাড়া সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ৯৩ টি স্লুইস গেটের মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো। ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় এগুলো পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
পাউবো-১ এর একটি তথ্যে দেখা যায় ১২৩টি স্লুুইস গেটেরে মধ্যে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালে নির্মিত ৩৫টি,১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সালে নির্মিত ৫টি,১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালে নির্মিত ৩০টি, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালে নির্মিত ৪৮টি এবং ১৯৮৯ থেকে ৯৩ সালে নির্মিত ৫টি। যার বেশির ভাগ স্লুুইস গেটের মেয়াদই শেষ।
জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালের ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সাতটি প্যাকেজে নদী খননের কাজ করা হয়।২০১১ সালে কপোতাক্ষ নদ খননের জন্য ৪ বছর মেয়াদী প্রায় ২৬২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেই প্রকল্পের বেশির ভাগ টাকায় লুটপাট হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্কেবেটর মেশিন দিয়ে দিয়ে চেঁচে-ছিলে দায়সারা গোচের খনন করা হয়েছে। ২৫ কোটি টাকার খনন করা হয়েছে সাতক্ষীরার এক সময়ের প্রমত্তা বেতনা নদী । কিন্তু খননের পূর্বের অবস্থার চেয়ে বর্তমান অবস্থা আরো খারাপ। খনন কাজের পূর্বে নদীটি কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার চওড়া ছিল। কিন্তু খননের পর নদীটি পরিণত হয়েছে নালায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, যাচ্ছে তাই ভাবে নদীটি খনন করায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বেতনা নদীর মাঝ বরাবর খনন করার কথা ছিল ১০ থেকে ১৮ ফুট। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি।
উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নে সাতক্ষীরার বেতনা নদী খনন ও পাড় বাঁধাই করার জন্য ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে টাকা তোলার অভিযোগ আছে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরায় বেতনা ছাড়াও মরিচ্চাপ নদী অদক্ষ পরিকল্পনার বলি হয়েছে। এছাড়া যমুনা, শালতা, শালিখা, সাপমারাসহ বিভিন্ন নদী-খালের অবস্থাও একই।
পানিউন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পে কাজ চলছে। প্রকল্পটির কাজ ২০২০ সালে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২৪ সালে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিগত অর্থ বছরে সাতক্ষীরা সদরের বিভিন্ন নদী ও খাল খনন এবং বাঁধ নির্মাণের জন্য ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। এরই অংশ হিসেবে গেল বছর ৩ কোটি এবং এবছর ৪০ কোটি টাকার প্যাকেজ হিসেবে অর্থ ছাড় হয়েছে। বরাদ্দকৃত এই অর্থে বিপরিতে বৈকারি সীমান্তের বাগধাড়ানি থেকে খইতলা হয়ে কুশখালি ছয়ঘরিয়া তলুইগাছা সীমান্তের ৮কি: ৩০০ মিটার বেঁড়িবাধ পূর্ণ নির্মাণের জন্য পাউবো-১, ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার টেন্ডার আহবান করে। কিন্তু বিএসএফের বাধার মুখে প্রকল্পটির কাজ বন্ধ আছে।
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …