বন্ধুত্বের রকমফের : প্রসঙ্গ নারী-পুরুষ সম্পর্ক // বিলাল মাহিনী

বন্ধু মানে এমন একজন যাকে নির্দ্বিধায় মনের সব কথা বলা যায়, যার সঙ্গে নিজের কষ্ট ভাগ করা যায়। ইংরেজীতে যাকে আমরা বলি ফ্রেন্ড এবং আরবীতে বলে ‘খলিল’। বন্ধুত্ব হলো মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক। আত্মার শক্তিশালী বন্ধন হল বন্ধুত্ব। সমাজবিদ্যা, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, এবং দর্শনে বন্ধুত্বের শিক্ষা দেয়া হয়। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ডেটাবেজ গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কারণে মানুষ সুখী হয়। (উইকিপিডিয়া)

‘বন্ধু’ এমন একটা শব্দ, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক আবেগ, ভালোবাসা, আস্থা, ভরসা। বন্ধু সবার জীবনে খুবই অপরিহার্য একটা অঙ্গের মতো।  বন্ধু মানে এমন একজন যাকে নির্দ্বিধায় মনের সব কথা বলা যায়, যার সঙ্গে নিজের কষ্ট ভাগ করা যায়, যে পাশে থাকলে পৃথিবী জয়ের সাহস পাওয়া যায়। একজন সত্যিকারের বন্ধু কখনোই তার বন্ধুকে ছেড়ে যায় না। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে সব সময়ই ছায়ার মতো পাশে থাকে। বাংলা অভিধানে এমন কিছু শব্দ আছে, যেগুলো আকারে ছোট হলেও গভীরতা অনেক। এমনই একটি শব্দ হলো ‘বন্ধু’। বন্ধু কাকে বলে বা বন্ধু মানে আসলে ঠিক কী, এ কথা জিজ্ঞাসা করলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন রকম উত্তর আসবে। কেউ কেউ বলেন, বন্ধু তো বন্ধুই। কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি দিয়ে বন্ধুকে মাপা যায় না।
কারো কারো মতে ‘বন্ধুত্ব মানে স্বরবর্ণের সঙ্গে ব্যঞ্জনবর্ণের সম্পর্ক’। এই বন্ধুত্ব যদি ছেলেমেয়ের মধ্যে হয়? তা কি নিছকই বন্ধুত্ব নাকি ভিন্ন কিছু। এ ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের একটি উদ্ধৃতি হলো-‘ছেলে এবং মেয়ে বন্ধু হতে পারে কিন্তু তারা অবশ্যই একে অপরের প্রেমে পড়বে। হয়তো খুবই অল্প সময়ের জন্য অথবা ভুল সময়ে। কিংবা খুবই দেরিতে, আর না হয় সব সময়ের জন্য। তবে প্রেমে তারা পড়বেই।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, ‘প্রেম মন্দির ও বন্ধুত্ব বাসস্থান। মন্দির হতে যখন দেবতা চলিয়া যায়, তখন সে আর বাসস্থানের কাজে লাগিতে পারে না, কিন্তু বাসস্থানে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।’ মনীষী নিটসে বলেছেন, বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে ছায়ার মতো। যে খুঁজে পেলো, সে একটা গুপ্তধন পেলো।’

মনোবিজ্ঞানী তুহিন সাইফুল বলেছেন, ছেলেমেয়ের সম্পর্ক বন্ধুত্বেরও হয়, আবার ভালোবাসারও হয়। অবস্থা বুঝে হয় একেক রকম। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোই ভালোবাসার দিকে গড়ায়। তা থেকে শেষ পর্যন্ত পাশাপাশি হেঁটে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী বলেন, একজন ছেলে আর একজন মেয়ে অবশ্যই প্রথমে বন্ধু হয়। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা হতেই পারে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে হবে এমনটা না। যেমন একজন মেয়ের যদি একাধিক বন্ধু হয়, তার মানে এটা না সে ওদের সবাইকে ভালোবাসে। একই কথা ছেলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বন্ধুত্ব যদি সীমার মধ্যে থাকে, তবে অবশ্যই সারা জীবন বন্ধু হয়ে থাকা সম্ভব। তবে কারো কারো ভিন্ন মতও আছে, যেমন- একজন ছেলে ও একজন মেয়ের মধ্যে শুধু ভালোবাসার সম্পর্ক হয়, এটা ভুল। বরং তার চেয়ে একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের খুব ভালো বন্ধুত্ব হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। সবাই তো আর বন্ধুত্বকে ভালোবাসায় গড়িয়ে নেয় না।

সব সম্পর্কের সেরা সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। শ্রীকৃষ্ণকে একবার বন্ধুত্ব আর প্রেমের মধ্যে কোনটির মূল্য বেশি বলে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, ‘প্রেম হলো সোনার মতো, যা ভেঙে গেলে আবার নতুন করে গড়া যায়। কিন্তু বন্ধুত্ব হলো হীরার মতো, যা একবার ভেঙে গেলে আর গড়া যায় না। অবশ্যই বন্ধুত্ব বেশি মূল্যবান।’ এই সুরে সুর মিলিয়েছেন নামীদামি অনেক বরেণ্য ব্যক্তিও! একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই এই বন্ধুত্ব ভালোবাসাতে পরিণত হয়। কারণ, ভালোবাসার মানুষে পরিণত হতে হলে আগে ভালো বন্ধু হতে হয়। বন্ধুত্ব থেকেই পরে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত ভালো বন্ধু শুধুই বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না। যদি দুজনের মনের মিল হয়ে যায়, তাহলে ভালোবাসা হতে পারে। সব ভালোবাসার মানুষই ভালো বন্ধু, কিন্তু সব ভালো বন্ধু ভালোবাসার মানুষ নাও হতে পারে।

উইলিয়াম শেকসপিয়ারও গেয়েছেন বন্ধুত্বের জয়গান। কাউকে সারা জীবনের জন্য কাছে পেতে হলে তাকে প্রেম দিয়ে নয়, বরং বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখার কথা বলেছেন তিনি। আর কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘প্রেম একসময় হারিয়ে যায়, কিন্তু বন্ধু কখনোই হারায় না।’ বন্ধু যখন বলে, ‘দোস্ত আমি জানি এটা তুই না পারলে আর কেউ-ই পারবে না।’ ব্যস! নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কি এটুকুই যথেষ্ট নয়? দুঃসময়ে যখন কেউ আমাদের ব্যথা বুঝতে চায় না, তখনো সত্যিকারের বন্ধু আমাদের পাশে থাকে।
তবে, শেক্সপিয়ার এও বলেছিলেন, “একজন ছেলে কখনো একজন মেয়ের বন্ধু হতে পারে না, কারণ এখানে আবেগ আছে, দৈহিক আকাক্সক্ষা আছে। ” একই কথা বলেছেন আইরিশ কবি ওসকার উইল্ড, তিনি বলেন, ‘নারী এবং পুরুষের মাঝে কেবলই বন্ধুত্বের সম্পক থাকা অসম্ভব। যা থাকতে পারে তা হলো আকাক্সক্ষা দুর্বলতা ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা। বন্ধুত্বের সর্ম্পক নিয়ে ঢোকা একটা ভ-ামী! শুধুই সুযোগের অপেক্ষা। সবশেষে পরিনতি পরকিয়া!  হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হতে পারে কিন্তু তারা অবশ্যই প্রেমে পড়বে। হয়তো খুবই অল্প সময়ের জন্য অথবা ভুল সময়ে। কিংবা খুবই দেরিতে আর না হয় সব সময়ের জন্য।  তবে প্রেমে তারা পড়বেই। শুধুই সুযোগের অপেক্ষা। ”

সত্যি বলতে, ছেলে ও মেয়েতে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব অসম্ভব ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ। কেননা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হলে প্রকৃতি নিজের অস্তিত্ব হারাবে। চুম্বক আর লোহা কখনো পাশাপাশি থাকতে পারে না। আকৃষ্ট করবেই। যদি কেউ তা এড়িয়ে যায় তবে সে ভ-ামি করছে নয়তো ধোঁকা দিচ্ছে। আগুনের পাশে মোম গলবেই। ছেলে ও মেয়ে বন্ধুত্ব হতে পারে, কিন্তু একসময় প্রেমে বা অবৈধ সম্পর্কে রূপ নিবেই। আর এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য নজির আছে যে, বন্ধুত্বের নামে প্রথমে সু-সম্পর্ক গড়ে পরে নারী পুরুষকে বা কখনো কখনো পুরুষ নারীকে লাঞ্চিত, অপমানিত এমনকি ধর্ষণও করছে। এজন্য পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মেই অবৈধ যৌনাচার ও পরনারীর সংস্পর্শে যাওয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে : যে, গুপ্ত অঙ্গ দেখায় এবং দেখে উভয়ে অভিশপ্ত। কাম প্রবৃত্তির প্রথম ও প্রারম্ভিক কারণ হচ্ছে দৃষ্টিপাত করা ও দেখা এবং সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে ব্যভিচার (যৌনাচার)। (তাবারানী)

সনাতন ধর্মে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্যই ঈশ্বর একই বিধান দিয়েছেন। ছেলের জন্য এক বিধান আর মেয়ের জন্য আরেক বিধান-এমন পক্ষপাতিত্ব ঈশ্বর করেন না। যেমন: ঋগ্বেদে (৮/৩৩/১৯) বলা হয়েছে “হে পুরুষ ও নারী! তোমাদের পোশাক ও দৃষ্টি সর্বদা ভদ্র ও অবনত হোক। তোমাদের চলন সংযত হোক, দেহ পোশাকে আবৃত হোক, নগ্নতা পরিত্যাগ হোক।” শ্রীরামচন্দ্র বলেছেন: “পোষাক নয়, চরিত্রই একজন নারীর প্রকৃত আবরণ।” (বাল্মীকী রামায়ণ: ৬/১১৪/২৭)

বন্ধুত্ব নামক সম্পর্ক থেকে আস্তে আস্তে সেটি বেহায়াপনার সম্পর্কে গিয়ে পৌছায়। এমনকি ব্যভিচারও হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “(হে রাসুল সাঃ) মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি (পরনারী হতে) নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। ঈমানদার নারীদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে (পরপুরুষ হতে) সংযত ও নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। – সুরা আন-নুর। (আয়াত ৩০-৩১)
বর্তমান সময়ে গার্ল ফ্রেন্ড, বয় ফ্রেন্ড সম্পর্ক থেকে অবৈধ মেলামেশা বেশী জনপ্রিয় এর কারন হচ্ছে এতে কারো প্রতি কারো কোনরূপ দায়বদ্ধতা থাকে না, কোন কমিটমেন্ট থাকে না। কারণ তারা তো বিবাহের রাষ্ট্রীয় নিবন্ধন নেই। তাই স্বাধীনভাবে উভয়ই দৈহিক আকাক্সক্ষা পূরণ করে নিচ্ছে। আর এটা সামাজিক এবং সংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির কারন হতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ প্রথাগতভাবে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আকর্ষণ আর নিজেকে আধুনিক হিসেবে জাহির করার মনোভাব এর হাতিয়ার। তাই অভিবাবকগণ এখনি যদি সতর্ক না হয় তবে আমরা ওই সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি যখন একটা ছেলে কিংবা মেয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না তার বাবা-মা কে!

বন্ধুত্ব টিকে থাক হাজার বছর ধরে। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব যেনো সমাজে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি না করে। কেননা দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় সব দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হানাহানীর পিছনে কোনো না কোনো নারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভুমিকা পালন করে। তবে প্রকৃত বন্ধু অপর বন্ধুর জন্য নিজের জীবনটাও বিলিয়ে দেয় যার অসংখ্য প্রমাণও আছে পৃথিবীতে। ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটা ছিল আগস্ট মাসের প্রথম শনিবার। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন রোববার ওই নিহত ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। সেই থেকে আগস্ট মাসের ১ম রোববার বন্ধু দিবস হিসেবে পালিত হয় অনেক দেশেই। তাই আসুন আমরা সেই বন্ধুত্বকে হ্যাঁ বলি যেখানে হৃদয়ের টান আছে, আছে ভালোবাসার বন্ধন, নিঃস্বার্থ আবেদন।

বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও  নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর । যুগ্ম সম্পাদক- ভৈরব-চিত্রা রিপোর্টার্স ইউনিটি। জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট। কাজের ক্ষেত্র : কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাহিত্য-সংস্কৃতি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা।

Please follow and like us:

Check Also

সাতক্ষীরা শহর জামায়াতের উদ্যোগে ইউনিট দায়িত্বশীল সমাবেশ অনুষ্ঠিত

স্টাফ রিপোটারঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সাতক্ষীরা শহর শাখার উদ্যোগে ইউনিট দায়িত্বশীল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।