আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় করোনাকালে বাল্যবিবাহের সংখ্যা প্রকট হয়েছে। নানা অযুহাতে অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, আদালতের দোহায়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারায় বাল্যবিবাহ বন্ধের লক্ষ্য অর্জনে পৌছাতে পারিনি জেলাটি। যদিও সাতক্ষীরা সদর,কালিগঞ্জ, শ্যামনগরসহ অনেক উপজেলা আগেই বাল্যবিবাহ মুক্ত উপজেলা ঘোষণা করে প্রশাসন। স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষক, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীরাও এসব বিয়ের আগে খোঁজ পাননি। বিয়ে হওয়ার পরে তা জানাজানি হয়েছে। আগামি ১২ সেপ্টেমর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসার পর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থিদের খোজ খবর নিতে থাকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খোজ নিতে যেয়ে অনেক ছাত্রীর খোঁজ মেলেনি। প্রতিবেশিরা জানান এসব মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে।
২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সর্বশেষ জরিপ (মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯-এমআইসিএস) বলছে, দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকারের কর্মপরিকল্পনায় ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, এ হার ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু ২০২০-২১ সালে এই হার কতটুকু কমেছে বা বেড়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায়নি।
২০১৪ সালের মার্চ মাসে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলাকে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করে ঢাকঢোল পেটানো হয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের হাতে লাল কার্ড পৌঁছে দেওয়া হয়। বাল্যবিবাহ বন্ধে তৎপরতা থাকলেও পরবর্তীতে তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ফলে বাল্যবিবাহপ্রবণ সাতক্ষীরা জেলায় একের পর এক এ ঘটনা ঘটতে থাকে।
এদিকে করোনা মহামারীর কারণে প্রায় ১৮ মাস যাবত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা তাদের অনেক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তারা বলেন, এলাকায় বখাটেদের উৎপাত, উত্ত্যক্ত করা, অপরহরণচেষ্টা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অ্যাসিড নিক্ষেপের আতঙ্কে তারা তাদের মেয়েকে বয়স পূর্ণ না হতেই বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডে অবস্থি সাতক্ষীরা আয়েনউদ্দীন মহিলা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো: রুহুল আমিন বলেন, মাদ্রাসা চলাকালে আমি নিজে এবং আমার একজন সহকারী শিক্ষককে নিয়ে প্রতিদিনই বাল্যবিবাহের খোঁজখবর নিতাম। ফলে কোনো বাল্যবিবাহ হওয়ার সুযোগ কম ছিল। তবে করোনাকালে মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় এ সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত ৩০টি বাল্যবিয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য আমি পেয়েছি। সব চেয়ে বেশি বিয়ে হয়েছে দাখিল পরিক্ষার্থীদের মধ্যে। এমনকি এক রোলসহ প্রথম ১০ জনের মধ্যে ৮ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল লতিফ জানান, এবার স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ৬৮ জন। এদের মধ্যে ৪৭ জন ফরম পূরণ করেছে, বাকি ২১ জন ফরম পূরণ করছে না কেন, খোঁজ করতে শিক্ষকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন, প্রত্যেকটি মেয়ের গোপনে বিয়ে হয়ে গেছে। দশম, নবম ও অষ্টম শ্রেণীর মেয়েদের বাল্যবিবাহের তথ্য ধরা পড়ে তারা অ্যাসাইনমেন্ট জমা না দেওয়ায়। তিনি বলেন, পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়েছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, তারা আর পড়বে না। প্রধান শিক্ষক আরও জানান, দুই মাস আগে তিনি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে ৪৭ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার তালিকা পাঠিয়েছিলেন। গত দুই মাসে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় বাল্যবিবাহ হয়েছে এমন ৫০ জনের মধ্যে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রী রয়েছে ৩২ জন। দশম শ্রেণীর ১৪ জন, নবম শ্রেণীর ৭ জন এবং অষ্টম শ্রেণীর ১১ জন রয়েছে। এ ছাড়া ১৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। স্কুলে থাকা তথ্য অনুসারে এই মেয়েদের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছর।
জেলার বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে গড়া বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির প্রশাসনিক প্রধান মো. সাকিবুর রহমান জানালেন, স্কুলটির ৫৭ ছাত্রীর বাল্যবিবাহের কথা তাঁরা জানতে পেরেছেন। দাদি-নানিদের ইচ্ছাপূরণ, মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক হওয়ার ভয়, বখাটেদের উৎপাত থেকে বাল্যবিবাহের ঘটনা বেশি ঘটে। তিনি আরো জানান, ২০২০ সালে এই ইউনিয়নে ৮৭টি বাল্যবিবাহ হয়। অপরদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিবাহ হয়েছে ৬৭ জনের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা তুজ জোহরা জানান, চলতি বছর আমরা ৪৯টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দিয়েছি। তবে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়েছে নিজের বাড়ি ও গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও। তিনি বলেন, করোনাকালে আমরা সবাইকে ঘরে থাকার কথা জানিয়েছি। এ সুযোগে সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। ফলে অভিভাবকরা গোপনে তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এখন সবকিছু খুলে দেওয়ায় বাল্যবিবাহ রোধ সহজ হবে।
আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ০৯-০৯-২০২১
০১৭১২৩৩২৯৯