“বিদায় হজ্জের শিক্ষা” মাও. মো. আনোয়ারুল ইসলাম

বিদায় হজ্জকে আরবিতে বলা হয় ‘হাজ্জুল ওয়াদায়ে’। হজ্জ শব্দের অর্থ হজ্জ করা, ইচ্ছা করা, গমন করা প্রভৃতি আর ওয়াদা শব্দের অর্থ বিদায় (আল-মু’জামুল ওয়াফী)। পরিভাষায় বিদায় হজ্জ বলতে বুঝায় রাসুল (স,) এর জীবনের শেষ হজ্জ আদায়কে। রাসুল (স.) জীবনে মাত্র একবার হজ্জ আদায় করার সুযোগ পেয়েছিলেন, ইসলামের ইতিহাসে এই হজ্জ বিদ্য়া হজ্জ নামে খ্যাত। রাসুল (স.) যুল-কদা মাসের পাঁচ দিন বাকি থাকতে হজ্জ উপলক্ষে রওনা করেন। হজ্জের প্রারম্ভে তিনি মানুষদেরকে হজ্জের নিয়ম কানুন শিক্ষা দেন। তারপর তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। নিন্মে এ ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও শিক্ষা সর্ম্পকে আলোচনা করা হলো ঃ

আল্লাহর প্রশংসার পর মহানবী সা. বলেন, ”হে জনগণ, আমার কথা শোন। আমি সম্ভবতঃ এই স্থানে এ বছরের পর আর কখনও তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারব না। হে জনতা আজকের দিেেন ও এই মাসে যেমন অন্যের জান মালের ক্ষতি সাধন তোমাদের ওপর হারাম তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত তা হারাম রয়ে গেল। যার কাছে কারো গচ্ছিত জিনিষ রয়েছে সে যেন মালিকের কাছে তা ফেরত দেয। তোমরা কারোর ওপর জুলুম করবেনা, জুলুমের শিকারও হবেনা। সকল সুদ রহিত করা হলো। তোমরা শুধু মুলধন পাবে। তোমাদের নারিদের প্রতি তোমাদের কিছু কর্তব্য এবং অধিকার রয়েছে। নরিরা তোমাদের বিছানায় অন্য কাঊকে শোয়াবেনা। এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত অশ্লীল কর্মকা-ে লিপ্ত হবেনা এটা তার কর্তব্য। কেননা এটা তোমাদের ঘৃণার ঊদ্রেক করে থাকে। আর তা যদি করেই বসে তবে তাদের থেকে আলাদা বিছানায় শোয়া এবং মৃদু প্রহার করার অধিকার আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন । কেননা তারা তোমাদের কাছে অক্ষম বন্দী স্বরূপ আল্লাহর আমানত হিসেবে তাদের গ্রহণ করেছ। আল্লাহর বিধান অনুসারেই তোমরা তাদেরকে বৈধ করে নিয়েছ। আর তোমাদের কাছে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো বিপথগামী হবেনা। প্রকাশ্য সুস্পষ্ট জিনিস আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের সুন্নাহ। জেনে রাখ, প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। মুসলমানরা ভাই ভাই। (সীরাতে-ইবনে হিশাম /৩৩০Ñ৩৩১)।

শিক্ষাঃ
*     বক্তব্য বা আলোচনার শুরুতে মহান আল্লাহর প্রশংসা করা ও তাঁর রাসুলের প্রতি দরুদ পেশ করা। রাসুল (স.) বলেন “যে কাজ বিসমিল্লাহ ব্যতিত আরম্ভ করা হয়, তাতে কোন বরকত থাকে না” (কুরতুবি)।
*   জীবনের প্রতিটি কাজ শেষ কাজ হিসেবে মনে করে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে আদায় করা। রাসুল (স.) বলেন “বস্তুত মানুষের আমল তার শেষ কর্মের ওপর নির্ভরশীল” (বুখারি মুসলিম)।

*    অন্যের প্রতি জুলুম করা হতে বিরত থাকা। রাসুল (স.) বলেন  “তোমরা অত্যাচারিত ব্যক্তির বদ দোয়া থেকে দূরে থাক কেননা অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া ও আল্লার মাঝে কোন পর্দা থাকেনা” (বুখারি ও মুসলিম)।
*   নারীদের প্রতি পুরুষের যে সম্স্ত কর্তব্য ও অধিকার রয়েছে তা হলো তাদের  মোহরানা (ফরজ মনে করে) পরিশোধ করা। আল্লাহ বলেন,স্ত্রীলোকদেরকে তাদের  মোহরানা সন্তুষ্ট চিত্তে আদায় করে দাও (সূরা নিসা ৪) । পুরুষের প্রতি নারীর যে সমস্ত কর্তব্য ও অধিকার রয়েছে তা হলো স¦ামীর অনুমতি ব্যাতিত গায়রে মুর্হারম কোন পুরুষকে তার ঘরে প্রবেশ করতে না দেওয়া। এবং সন্তানদেরকে দ্বীনি পরিবেশে গড়ে তোলা। রাসুল (স.) বলেন,“ আর স্ত্রী  তার স্বামীর ঘরÑসংসার ও সন্তানÑসন্ততির ওপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাব দিহি করতে হবে”(বুখারি ও মুসলিম) । স্বামী স্ত্রীর পরসপরের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন “তাঁর নিদর্শন সমুহের মধ্য এও (একটি) যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদেরই জাতির মধ্যে হতে স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাদের নিকট পরম প্রশান্তি লাভ করতে পার । আর তোমাদের মধ্যে ভালবাসা সহৃদয়তার সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এতে বিপুল নিদর্শন নিহিত রয়েছে সেই লোকদের জন্যে যারা চিন্তা ভাবনা করে (সুরা রূম ২১)।  আল্লাহ আরও বলেন “তারা তোমাদের পক্ষে পরিচ্ছেদ স্বরূপ আর তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছেদ ” (সুরা বাকারা ১৮৭)।

*    আমানাতের খেয়ানত না করা । রাসুল (স.) বলেন, “মোনাফেকের আলামত হলো যখন তার কাছে কোন কিছু আমানাত রাখা হয় তখন সে তা খিয়ানত করে” (বুখারি ও মুসলিম)। মুনাফেকদের স্থান হলো জাহান্নামের সব্ নি¤েœ। আল্লাহ বলেন,“ নিশ্চয় মুনাফিকেরা জাহান্নামের সর্ব্ নি¤œ স্থানে অবস্থান করবে”( সুরা নিসা ১৪৫)।

*   সুদ দেওয়া ও নেওয়া থেকে বিরত থাকা। রাসুল (স.) বলেন,“চার ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ সিদ্বান্ত নিয়েছেন যে, তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না এবং জান্নাতের নেয়ামতের স্বাদ গ্রহণ করতে দেবেন না। (১) মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি (২) সুদখোর (৩) অন্যায়ভাবে এতিমের মাল ভক্ষণকারী (৪) পিতা মাতার অবাধ্যকারী।”(মুস্তাদারাক-হাকেম) ।

*   মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতিত্ব বোধ জাগ্রত রাখা। রাসুল (স,)“ বলেন,পারস্পারিক দয়া ভালবাসা ও সহানুভুতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদের একটি দেহের মত দেখবে যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয় তখন শরীরের সকল অঙ্গÑপ্রতঙ্গ রাত জেগে জ¦রে অংশ নেয়”(বুখারি ও মুসলিম) ।

*  কুরআন এবং হাদিসকে জীবন চলার পথে একমাত্র পথ নির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষট্রীয় ও আর্ন্তজাতিক জীবনের  সকল সমস্যা সমাধানে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশকে নত শিরে মেনে নেওয়া। আল্লাহ বলেন,“হে ঈমানদারেরা, তোমরা পরিপুর্ণ ভাবে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ কর। এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা, কেননা সে তোমাদের  প্রকাশ্য শত্রু” ( সূরা বাকারা-২০৮)।

*   বিদায় হজ্জের ভাষণ বিশে^র সকল^ মুসলমানদের জন্য বড় এক নেয়ামত বা সম্পদ। রাসুল (স.) এ ভাষণে তিনি  ঊপস্থিত সাহাবি আজমাইন (রা.) ও অনাগত মুসলমানদের করণীয় ও বর্জনীয়  সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তাদের দুনিয়া জীবনের শান্তি ও পরকালিন জীবনের মুক্তির জন্য এ ভাষণের অনুসরণ ও বাস্তবায়নই যথেষ্ট। অথচ  আজ তারা এ মহামূল্যবান ভাষণকে পাশ কাটিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের ভাষণের মধ্যে শান্তি ও মুক্তি খুেজ বেড়াচ্ছে। যেটা প্রকারন্তে রাসূল (স.) কে অবমননার শামিল। অথচ মহান  আল্লাহ বলেন“হে নবী!লোকদের বলে দাও তোমরা যদি  প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ভালবাসা পোষণ কর তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়”(সুরা আলে ইমরান ৩১)। তাই আসুন যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই রাসুল (স.) কে ভালাবসি এবং শান্তিময় জীবন যাপন করতে চাই তাহলে আমাদের কর্তব্য হলো রাসুল (স.) এর বিদায় হজ্জের ভাষণের  শিক্ষাকে আমাদের ব্যক্তিগত , পারিবারিক ,সামাজিক, রাষ্টিয় ও আর্ন্তজাতিক জীবনের সকলক্ষেত্রে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন । আমিন!

মাওঃ মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম
 উপধ্যক্ষ
 গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর

Check Also

আব্দুর রহমান কলেজের বিধিবহির্ভূত এডহক কমিটি বাতিল চেয়ে আবেদন

সূত্র ঃ তারিখ ঃ ২০-১০-২০২৪ ইংবরাবরজেলা প্রশাসকসাতক্ষীরা। বিষয় ঃ বিধিবহির্ভূত এডহক কমিটি বাতিল প্রসঙ্গে। জনাব,যথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।