অস্থিত্ব সংকটে উপকূলীয় জেলা সমূহ: ২১টি জেলার লাখ লাখ মানুষ হুমকির মুখে

আবু সাইদ বিশ্বাস:উপকূলীয় অঞ্চল থেকে: পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত বাংলাদেশর উপকূলীয় অঞ্চলের অস্থিত্ব বিলীন হওয়ার সংকটে পড়েছে। বদ্বীপ গঠনের তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আমলে না নিয়ে যত্রতত্র অবাধে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বদ্বীপের প্রাকৃতিক পলিপ্রবাহ ও অবক্ষেপণে মাত্রাতিরিক্ত বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। বরিশালকে বলা হতো দেশের খাদ্যভান্ডার। কৃষি উৎপাদনে সেই বরিশাল এখন অনেক পেছনে পড়ে গেছে। উপর্যুপরি দুর্যোগ, জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চিংড়ি চাষ, নদীর ভাঙন,ভারতীয় ফারাক্কা বাঁধসহ নানা কারণে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলী জেলা সমূহে জনসংখ্যা কমে অন্যত্র অভিগমন করছে। গবেষণায় দেখা গেছে,এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উপকূলীয় এলাকায় ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা আরও ১৩ লাখ কমে যেতে পারে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রতিটি কারণই ভবিষ্যতে তীব্রতর হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অশুভ প্রবণতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের উপকূলভাগের লাখ লাখ মানুষ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়িবাঁধ ভেঙে সাগরের নোনা পানিতে উপকূলভাগের হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। মাছের ঘের তলিয়ে গেছে জলোচ্ছ্বাসে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে শভঙ্করের ফাঁকি থাকায় লাখ লাখ মানুষ জলোচ্ছ্বাসে ঘর ও জীবিকা হারিয়েছেন। দেশের সাগর তীরবর্তী অর্থাৎ উপকূলীয় ২১টি জেলায় লাখ লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ উপকূলের যথাযথ সুরক্ষা না থাকায় উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ ক্ষতবিক্ষত হয়ে আজ উপকূল বাসির জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে।
দেশের উপকূলীয় এলাকার ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। গত বছর আম্পানে উপকূলীয় জেলার ১৫২টি স্থানে ৫০ দশমিক ৪৭৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে বিলীন হয়েছে। ৫৮৩টি স্থানে ২০৯ দশমিক ৬৭৮ কিলোমিটার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৪৮টি নদীর তীর ভাঙনে ১৩ দশমিক ২০৮ কিলোমিটার বিলীন হয়েছে এবং ৩৭টি নদীর তীর সংরক্ষণ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের ক্ষতি হয়েছে ১২ দশমিক ৮০০ কিলোটার। এই বিধস্ত উপকূলকে এখনো মেরামত করা হয়নি। ফলে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে ও টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ভাসছে উপকূলের জেলাগুলো।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণি, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও সর্বশেষ এ বছর ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। প্রতিবছর এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ভাঙাচোরা অববাঠামো আরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এতে করে উপকূলবাসী জীবন-জীবিকা এবং মূল্যবান অবকাঠামো হুমকির মুখে রয়েছে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় পোল্ডারগুলো অনেক পুরোনো। বেশির ভাগেরই বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি। এগুলো মাটির তৈরি হওয়ায় এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। উপরন্তু চিংড়ি চাষের সুবিধার্থে লবণপানি ঢোকানোর জন্য যত্রতত্র বাঁধের ভেতরে ছিদ্র করায় বা পাইপ বসানোর ফলে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে পোল্ডারগুলো । এছাড়া গঙ্গি ব্যারেজের কারণে ফারাক্কা বাঁধের জন্য ওপর থেকে পানি আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ওপর থেকে স্বাদু পানির প্রবাহ না থাকায় নদীর লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।
উপকূলীয় অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে জনজীবনে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাঁরা বলছে আগে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এই সংকট দেখা দিলেও এখন স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
সংসদ আমিরুল আলম মিলন বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণ ঘুর্ণিঝড় সিডরের ক্ষত এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে। আকাশে মেঘ দেখলেই ওই এলাকার জনমনে আতংক দেখা দেয়। এই আতংক থেকে রক্ষায় উপকূলে টেকসই বাঁধের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।
সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধের ক্ষতি হলে তাদের সবকিছু ভেসে যায়। বাড়িঘর নষ্ট ও ফসলের ক্ষতি হয়। তাই ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে জরুরি খাবার না দিয়ে, বাঁধটা শক্ত করে বানিয়ে দেওয়ার দাবিটাই প্রধান।
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকূলের অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে উল্লেখ করেন এমপি এসএম শাহজাদা। তিনি বলেন, গুরুত্ব বিবেচনায় না নিয়ে ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে সরকারী অর্থের অপচয় হয়। অথচ উপকূলের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো পাসের অপেক্ষায় পড়ে থাকে। বিশেজ্ঞরা বলছে, সরকারের উন্নয়নের নামে উপকূলীয় অঞ্চলে লুটপাট চলছে। টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হাজিখালি খালে পানিনিষ্কাশনের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি জলকপাট কাজে আসছে না। এ প্রকল্পের আওতায় উপকৃত এলাকার জমির পরিমাণ ১১ হাজার ২৯৬ হেক্টর। বেতনা নদীর হাজিখালি বিলের খালের মুখে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একটি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি; বরং জলকপাটটি স্থানীয় লোকজনের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানিনিষ্কাশন না হওয়ায় সদর উপজেলার বেতনা নদীর তীরের গ্রামগুলো ডুবে রয়েছে পানিতে। একই অবস্থা উপকূলীয় আরো অনেক জেলা সমূহে।

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ২৭/০৯/২০২১

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।