নাজমুল শাহাদাৎ জাকির: চলতি বছর সাতক্ষীরার সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস চালু হলে বুক ভরা আশা নিয়ে বাপ হারা সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে থাকেন সাতক্ষীরা মিল বাজার এলাকার বাসিন্দা বিধবা রেখছোনা খাতুন। তবে করোনায় মিলস বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ে চাকরী হারায় সে। ফলে এতিম সন্তানদের নিয়ে বর্তমানে পথেপথে দিনপার করতে হচ্ছে তাকে। রেখছোনার মতো একই অবস্থা স্বামী পরিত্যক্তা পারভীন সুলতানার। সাতক্ষীরার সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস এ কাজ করার পর থেকে ভালোই চলছিলো তার সংসার। তবে করোনায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ে রেখছোনার মতো চাকরী হারায় সে। ফলে বর্তমানে মানবতার ভাবে জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাকে। শুধু রেখছোনা বা পারভীন নয় বরং করোনায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ে এই টেক্সটাইল মিলস থেকেই চাকরী হারিয়েছে তিনশত জনেরও অধিক শ্রমিক। তবে কর্মক্ষেত্রে তাদের ছিলোনা কোন নিয়োগ বা চুক্তিপত্র। ফলে আইনের আশ্রয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ না থাকাই চাকরী হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। শুধু সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস নয় বরং নিত্যসময় জেলার বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের যেকোন শ্রমিককে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ছাঁটাই করে মালিকপক্ষ। তাছাড়া জেলার বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেও পায় না তাদের ন্যায্য অধিকার। শারিরীক নির্যাতন, গালিগালাজ ফ্রি, নামমাত্র মুজুরীতে কাজ করতে হয় তাদের। নেই ছুটি নেই কর্মঘন্টা। অথচ শোভন কাজের অন্যতম পূর্ব শর্ত হল শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরী করা।
কিন্তু এমনিভাবে অধিকার বঞ্চিত থেকে প্রতিটি মুহূর্তে কাজ করে যাচ্ছেন সাতক্ষীরার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ৫ লাখ শ্রমিক। তবে এবিষয়ে আইন থাকলেও মানছেনা মালিকপক্ষ। ফলে যেসব শ্রমিকের হাত ধরে এই প্রবৃদ্ধি, সেই শ্রমিকদের শ্রম অধিকার আজ নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তবে নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মালিকপক্ষের দায়িত্ব। কিন্তু শ্রম আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন না থাকার কারণে কর্মক্ষেত্রে অরক্ষিত শ্রমিকরা। নেই চাকরির কোনো নিরাপত্তা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে শ্রমিক নির্যাতন ও নারী-পুরুষের মুজুরী বৈষম্য। অথচ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে সবচেয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। যে কোনো সময় চাকরি হারানোর ঝুঁকি থাকে। কর্মক্ষেত্রে কোনো শ্রমিক নিহত হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও অনেকটাই নিহত শ্রমিক স্বজনের কাছে পৌঁছায় না।
শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা, অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এর পাশাপাশি শ্রমিক নির্যাতন বন্ধ না করতে পারলে হুমকির মুখে পড়বে দেশের অর্থনীতি। একারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শোভন কর্মপরিবেশ তৈরী করতে শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা এখন সময়ের দাবী। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথা এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৮ নং লক্ষ্য সবার জন্য শোভন কাজ নিশ্চিত করা। আইএলও’র এশিয়া প্রশান্ত মহসাগরীয় ১৬তম আঞ্চলিক সম্মেলনে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে শোভন কাজকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। আইএলও’র মতে, যে কর্মসংস্থান শ্রমিকের ন্যায্য আয়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত উন্নয়নের সম্ভাবনা, পারিবারিক-সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, তা-ই শোভন কাজ। শোভন কাজ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেয়, সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে, অর্থনীতিতে গতি আনে ও টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে। তবে মালিক পক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে শোভন কর্ম পরিবেশ আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শোভন কাজের অন্যতম পূর্ব শর্ত হল শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা পরবর্তী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল শ্রম-আইন সংশোধন। শ্রমিকদের জন্য উৎসব ভাতা, শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, নারী শ্রমিকদের প্রসূতি ছুটি, মালিক-শ্রমিক-সরকারের ত্রিপক্ষীয় পরিষদ, ছয় মাসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি, ২৫ জন শ্রমিক হলে কারখানায় খাবার কক্ষের বিধান রেখে ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনী-২০১৮’ গেজেট আকারে প্রকাশ পায়। এতে মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন অপরাধের শাস্তিও কমানো হয়। তবে এই আইনটি ইপিজেড এলাকার কারখানার জন্য প্রযোজ্য নয়। বর্তমানে শ্রম আইনে ৩৫৪টি ধারা রয়েছে। সংশোধিত আইনে নতুন দুটি ধারা, চারটি উপধারা ও আটটি দফা সংযোজন এবং ছয়টি উপধারা বিলুপ্ত করা হলেও বাস্তবে এই আইনের কোন প্রয়োগ নেই। বর্তমানে সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের চাকুরির নিরাপত্তা একেবারে নেই বললেই চলে। শ্রমিকের চাকরিকাল সম্পূর্ণ নিয়োগকারীর ইচ্ছাধীন একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছরই যেকোন শ্রমিক অসন্তোষে কিংবা অন্যায়ভাবে শ্রম অধিকার লঙ্ঘন করে শ্রমিকদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়। যার বাস্তব উদাহরণ সাতক্ষীরার সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা তেমন জোরদার না হওয়ায় এই খাতের শ্রমিকরাই বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন। এছাড়া প্রতিকূল কাজের পরিবেশ, একটানা পরিশ্রমের ফলে স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধার অভাব এই খাতের শ্রমিকদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে অনেকাংশে ব্যাহত করছে।
এমতাবস্থায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সমন্বিত করে মূল দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। শ্রমিকদের শোভন জীবনমান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় ক্ষেত্রে আলোচনার পথ প্রশস্ত করে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার মধ্য দিয়ে ‘বৈশ্বিক জবাবদিহিতামূলক সরবরাহ ব্যবস্থা কাঠামো’ গড়ে তুলতে হবে, যার মধ্য দিয়ে তৈরী হতে পারে নিরাপদ কর্মপরিবেশ। দেশে কর্মরত শ্রমশক্তির প্রায় ৩৯ শতাংশ নিয়োজিত আছে কৃষি খাতে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সর্বোপরি এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে কৃষি খাত যে অনন্যসাধারণ অবদান রেখে চলেছে তা নজিরবিহীন। অথচ এখানে কর্মরত শ্রমশক্তির ৯৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক!
কৃষির পরেই কর্মসংস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে সেবা খাত। অনধিক ২ কোটি ৩৭ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছে এই খাতে। তারপরের স্থান শিল্প খাতের যেখানে কাজ করে প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ শ্রমিক। ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭’ এর তথ্য অনুযায়ী সেবা খাতে কর্মরত শ্রমশক্তির প্রায় ৭২ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক অন্যদিকে শিল্প খাতে এই সংখ্যা আরও উদ্বেগজনক প্রায় ৯০ শতাংশ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রতি সরকারের অনতিবিলম্বে সুদৃষ্টি দিতে হবে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি আইনি কাঠামো যার মধ্যে দিয়ে স্বীকৃতি মিলবে এই খাতের এবং একই সঙ্গে এই খাতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শ্রমশক্তির ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করতে যা পালন করবে রক্ষাকবচের ভূমিকা।