আবু সাইদ,সাতক্ষীরা: সরকারের ইতিবাচক নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও বারবার সমালোচনার মুখে পড়ছে স্বাস্থ্য খাত। করোনার এই সংকটপূর্ণ সময়ে প্রতিদিন মানুষের প্রাণ ঝরলেও টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্টদের। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা স্বাস্থ্যসামগ্রী বছরের পর বছর অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। জনগণের করের টাকায় কেনা মূল্যবান চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো মানুষের কোনো কাজেই আসছে না। উল্টো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে থাকায় এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম অকেজো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয়ে এক্সরে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন, আইসিইউ ভেন্টিলেটর, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, পেশেন্ট মনিটর, ডিফিবিলেটর, নেবুলাইজার মেশিন, সাকশন মেশিনসহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা হয়। বিশ্বের নামিদামি প্রতিষ্ঠানের আধুনিক মডেলের এসব চিকিৎসা সরঞ্জামের আর্থিক মূল্য সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু এসব চিকিৎসাসামগ্রীর সুফল আজও ভোগ করতে পারেনি সাতক্ষীরাবাসী। অজ্ঞাত কারণে তিন বছরের বেশি সময় ধরে এসব যন্ত্রপাতি রোগীদের জন্য ব্যবহার না করে হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে। গতকাল সরেজমিন হাসপাতাল ঘুরে অনেক যন্ত্রপাতি এখনো প্যাকেটবন্দী অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্যাকেটের গায়ে জাল বুনেছে মাকড়সা। করোনায় সাতক্ষীরায় গতকাল পর্যন্ত ৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকের মৃত্যু হয়েছে আইসিইউ ভেন্টিলেটর সুবিধা না পেয়ে। অথচ সদর হাসপাতালের জন্য কেনা আইসিইউ ভেন্টিলেটরটিও অব্যবহৃত পড়ে আছে ২০১৮ সাল থেকে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় সীমান্তজেলা সাতক্ষীরায় পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি হলেও কর্তৃপক্ষ এসব চিকিৎসাসামগ্রী রোগীদের সেবায় ব্যবহার করেনি। সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর ব্যবহার না করায় অনেক রোগীকে অকাতরে প্রাণ দিতে হয়েছে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দৈনিক খুলনাকে বলেন, আমরা টিভিতে দেখেছি সাতক্ষীরায় করোনা রোগী ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। বারান্দায় শুয়ে ধুঁকছে অনেকে। তখনই বলেছিলাম, এই হাসপাতালগুলোতে সুযোগ বাড়াতে হবে। অথচ অনেক যন্ত্রপাতি আগেই কেনা আছে, কিন্তু ব্যবহার হচ্ছে না। বিষয়টা হতাশার। এই হাসপাতালেই হয়তো চিকিৎসার অভাবে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এ দায় তো সরকারের ঘাড়েই বর্তায়। এদিকে সাতক্ষীরায় ক্রয় করা এসব চিকিৎসাসামগ্রীর অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালের মে মাসে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত কমিটিও অতি দামি চিকিৎসাসামগ্রী অবহেলায় পড়ে থাকার চিত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের একটি অংশে বলা হয়, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্টোর বিভাগ পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ক্রয়কৃত যন্ত্রপাতিগুলোর বেশ কিছু সংখ্যক বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আবার কিছু সংখ্যক যন্ত্রপাতি খোলা অবস্থায় সদর হাসপাতালের বিভিন্ন অপারেশন থিয়েটার ও ল্যাবরেটরিতে পাওয়া যায়, যাদের বেশির ভাগ আনইনস্টল (চালু হয়নি) অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বিশাল সংখ্যক যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী অবস্থায় দীর্ঘদিন স্টোরে পড়ে থাকলে এবং আনইনস্টল অবস্থায় অব্যবহৃত থাকলে তা পরবর্তীতে অচল ও মেরামতের অযোগ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সরকারি অর্থের অপচয় হয় ও সরকারি সম্পদ জনস্বার্থে ব্যবহৃত না হয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এদিকে একই বিষয়ে গঠিত অপর একটি কমিটিও প্রায় অনুরূপ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ক্রয় করা যন্ত্রপাতি সার্ভে করার জন্য খুলনা বিভাগের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) দফতর থেকে ডা. মো. আতিয়ার রহমান শেখকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। চিকিৎসা যন্ত্রপাতি পরিদর্শনের পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, সংখ্যাগত (পরিমাণ) দিক দিয়ে যন্ত্রপাতি ও মালামাল সঠিক আছে। বাক্সবন্দী যন্ত্রপাতিগুলো যেমন- এক্স-রে মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন, আইসিইউ ভেন্টিলেটর ইনস্টল করা প্রয়োজন। প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু যন্ত্রপাতি যেমন এক্স-রে মেশিন, ক্লিনিক্যাল কেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন সদর হাসপাতালে ব্যবহার করা হচ্ছে, তবে কিছু মালামাল সিভিল সার্জন অফিসের বারান্দায়, কিছু সদর হাসপাতালের অভ্যন্তরে জেলা আইপিআই স্টোরে ফেলে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, তিন-চার বছর চিকিৎসা সরঞ্জাম অব্যবহৃত থাকলে প্রথমত এগুলো অকেজো হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, এর চেয়ে উন্নত সংস্করণ বাজারে আসায় এর উপযোগিতা থাকে না। অথাৎ, অর্থ খরচ হলো কিন্তু মানুষ তার সুফল পেল না। জনগণের টাকার এমন অপচয় করার অধিকার কারও নেই। এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বলছেন, হাসপাতালে এলেই বলা হয় এটা নেই, ওটা নেই। হাসপাতাল থেকেই বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। চিকিৎসাই যদি না পাওয়া যায়, তাহলে হাসপাতাল রেখে লাভ কী? জনগণের করের টাকায় কেনা মূল্যবান এসব আধুনিক চিকিৎসাসামগ্রী বছরের পর বছর বাক্সবন্দী অবস্থায় ফেলে রাখা রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন ওই হাসপাতালেরই অনেক কর্মচারী। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত বলেন, এ মালামালগুলো ঠিকাদারের। আমাদের মালামাল হলে স্টোরে থাকত। যে কারণে ঠিকাদারের মালামাল কোথায় কীভাবে রেখেছে শুধু ঠিকাদারই জানেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর যতক্ষণ পর্যন্ত চিঠি দিয়ে আমাদেরকে অনুমতি না দেবে ততক্ষণ আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারি না। এটি নিয়ে দুদকে মামলা চলছে। বিষয়টি তাদের আয়ত্তে রয়েছে। এ ঘটনায় গত জানুয়ারিতে মাইন উদ্দিন নামে একজন যুগ্ম সচিব মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তে এসেছিলেন।
Check Also
আশাশুনিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি প্রতিনিধি।।ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অভ্যুত্থানের শক্তি নাগরিক,আহত …