দেবহাটার খলিশাখালি এখন মগের মুল্লুক, চলছে হরিলুট

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালিতে ১৩’শ ২০ বিঘা (৪৩৯.২০ একর) জমি ও মৎস্য ঘের ভুমিহীন নামধারী ভূমিদস্যু সন্ত্রাসী কর্তৃক অবৈধভাবে জবর দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশী ও বিদেশী অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা ফিল্মি ষ্টাইলে এই সম্পত্তি দখল করেছে বলে জানিয়েছেন জমির মালিকরা।

তবে, সম্পত্তি উদ্ধার করতে প্রকৃত রেকর্ডীয় মালিকরা প্রশাসনের কর্তাদের কাছে ধর্ণা দিয়েও তারা তাদের সম্পত্তি এখনও বুঝে না পেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে তারা জানিয়েছেন। তবে, নামধারী এ সব ভুমিহীনরা ওই সম্পত্তি খাস বলে দাবী করলেও জেলা প্রশাসক বলছেন এই সম্পত্তি সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং এখানে কোন খাস জমি নেই। বিশৃংখলা এড়াতে আইনশৃংখলা বাহিনী তৎপর রয়েছেন বলে তিনি দাবী করেন।

এদিকে, সাংবাদিকরা মঙ্গলবার সরজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে সেখানে রাস্তায় উপর বাঁশ ফেলে ও বাঁশ টানিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয় নামধারী এসব ভুমিহীনরা। খলিশাখালী সড়কের উপর নির্মিত একটি ব্রিজের উপর শতাধিক মহিলারা একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। সেখানকার নামধারী ওই সব ভুমিহীন নেতাদের সাথে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে তাদের পক্ষে রিপোর্ট করার আশ^াস দিলে তারা সাংবাদিকদের সেখানে মাইক্রোবাসটি রেখে পায়ে হেটে যাওয়ার অনুমতি দেন। নিজেদের রক্ষা করতে এসব নামধারী ধূর্ত ভমিহীনরা ইতিমধ্যে ওই স্থানকে “শেখ মুজিবনগর খলিশাখালী আবাসন কেন্দ্র” নাম ঘোষণা করে সেখানে লাল পতাকা তুলে দিয়েছেন।

জমির মালিক আইডিয়াল পরিচালক ডা. মোঃ নজরুল ইসলাম, কাজী গোলাম মোরশেদ ও মোঃ আনছার আলীসহ কয়েকজন জানান, খলিশাখালিতে রেকর্ডীয় ও লীজকৃত ৩০টি খন্ডে বিভক্ত তাদের বিস্তীর্ণ মৎস্য ঘের ও জমি স্থানীয় কিছু ভূমিহীন নামধারী এবং জেলা ও জেলার বাইরে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ৭ শতাধিক সন্ত্রাসী অস্ত্রেসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গত ১০সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত্র আনুমানিক ২ টার দিকে মৎস্য ঘেরের কর্মচারীদের মারধর করে জোরপূর্বক দখল করে নেয়।

দখলের পর তারা উক্ত মৎস্য ঘের থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকার মাছ লুট এবং ঘেরের বাসাবাড়ি ভাংচুর করে আনুমানিক ৩৬ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতিসাধন করে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিকার চেয়ে তারা দেবহাটা থানা কর্তৃপক্ষকে জানালে থানা কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বলে জানান তারা। এমনকি উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে জমির মালিকগন দেবহাটা থানায় মামলা করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ কোন মামলা গ্রহণ না করে তাদের ফিরিয়ে দেন। নিরুপায় হয়ে তারা গত ১২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা কোর্টে মামলা দায়ের করা হলে আদালত মামলা গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

তারা আরো জানান, খালিশাখালিতে ২৭টি দাগে ৪৩৯.২০ একর (১৩’শ ২০ বিঘা) জমির মালিক চন্ডীচরণ ঘোষ। সেখান থেকে বিভিন্ন কোবলা দলিল, পাট্টা দলিল ও কোর্টের রায় মোতাবেক এসএ ২৯৬২ থেকে ২৯৮০ খতিয়ানে রেকর্ড প্রকাশের পূর্বে কলিকাতা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে বিগত ০৮/০৩/৫৩ তারিখে ৬৯৪ নং বিনিময় দলিল মূলে দেবহাটা থানার তেজেন্দ্রনাথ চৌধুরীর পুত্র সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরীরর সাথে বিনিময় করেন।

এসএ রেকর্ড পরবর্তী উক্ত বিনিময় দলিলের গ্রহীতা শিমুলিয়া গ্রামের কাজী আব্দুল মালেক এর ওয়ারেশগণসহ ক্রমিক হস্তান্তর সূত্রে অপরাপর মালিকগণ বর্তমানে বিএস রেকর্ড প্রাপ্ত হন এবং তৎপরবর্তী প্রিন্ট পর্চাসহ প্রায় ৩০০ মালিকের নামে প্রায় ২০০টি পর্চায় উক্ত সমুদয় সম্পত্তি গেজেট প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে অনেক জমির মালিকগন হালসন পর্যন্ত খাজনাও পরিশোধ করেছেন। উক্ত সম্পত্তি ভোগদখল করার অসৎ উদ্দেশ্যে সাতক্ষীরা যুগ্ম জেলা জজ আদালতে জনৈক জোনাব আলী ১৮/২০১০ নং মামলাটি দায়ের করেন। সেক্ষেত্রে মামলা চলাকালীন সময়ে উক্ত সম্পত্তি জেলা প্রশাসক আইনানুযায়ী নিয়ন্ত্রণে রাখবেন।

যেহেতু উক্ত জমির সিএস রেকর্ড থেকে এসএ ও বিএস রেকর্ডের প্রিন্ট পর্চা মালিকদের নামে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, সেহেতু সুপ্রিম কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে বিবাদী পক্ষ সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। যে সম্পত্তি ১৯৫৩ সাল থেকে সিএস, এসএ এবং প্রিন্ট পর্চাসহ গেজেট প্রকাশিত হয়েছে এবং ৭০ বছর যাবত বিবাদী পক্ষ ভোগদখলে আছেন, সেই সম্পত্তিতে অন্যপক্ষের যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। অথচ উক্ত সম্পত্তি রাতের আঁধারে জোরপূর্বক দখল করে প্রতিরাতে সেখান থেকে মাছ লুট করা হয়েছে। তারা এ সময় উক্ত সম্পত্তি দখলমুক্ত ও প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবী জানান।

সরজমিনে সেখানে গেলে নামধারী ভুমিহীন রবিউল ইসলাম, শরিফুল ইসলাম, হাসিনা বেগম, মাজেদা বেগম, আনোয়ারা বেগম, শাহিনা পারভীনসহ অনেকেই জানান, এই সম্পত্তি পুরাটাই খাস জমি। তাদের কোন জায়গা জমি না থাকায় তারা এই খাস জমি দখল করে সেখানে বসবাস করছেন বলে জানান। এ সময় তাদের কাছে মাছ লুট করেছেন কেন এমন প্রশ্ন করা হলে তার জবাবে তারা বলেন, লুট করা হয়েছে এমন কথা বলবেননা। মাছগুলো যে যার মত ধরে নিয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা ভুমিহীন সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ জানান, ইতিমধ্যে খলিশাখালীতে জমি দখলে নেতৃত্বদানকারী নামধারী ভুমিহীনদের ভুমিহীন সমিতি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি এ সময় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানান।

সাতক্ষীরা জেলা গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও ভুমিহীন নেতা আলীনুর খান বাবুল জানান, দীর্ঘদিন ধরে ভুমিহীনদের নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। কিন্তু বর্তমানে যে নামধারী কিছু বহিরাগত ভুমিহীন সন্ত্রাসী খলিশাখালীতে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি খাস বলে সন্ত্রাসী ষ্টাইলে দখল করেছেন এর তীব্র নিন্দা ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে প্রশাসনের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি। তিনি জানান, খলিশাখালীর ৪৩৯.২০ একর জমির মধ্যে ১২.৭৯ একর খাস জমি রয়েছে কিন্তু সেগুলো খাল ও রাস্তার মধ্যে। তিনি আরো জানান, প্রকৃত ভুমিহীনদের ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করার জন্য বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করা হয়েছে।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ন কবির জানান, খলিশাখালীতে ৪ শতাধিক একর জমি জবর দখলের খবর আমাদের নজরে এসেছে। এক পক্ষ আবেদনও করেছেন। আমরা নথি ও কাগজ পত্র যাচাই বাছাই করে দেখলাম এই সম্পত্তি পুরোটাই ব্যক্তি মালিকানাধীন। তবে, ৪ শতাধিক একর এর মধ্যে ১০/১২ একর জমি খাস রয়েছে সেটি খালের মধ্যে, আর বাকীটা সম্পুর্ণই ব্যক্তিমালিকানাধীন। তিনি জানান, ইতিপূর্বে এই জমি নিয়ে যে মামলা চলছিল তার সকল কাগজ পত্র জিপি সাহেবকে দেয়া হয়েছে। তিনি একটি প্রতিবেদন আমাদেরকে দেবেন। বিশৃংখলা এড়াতে আইনশৃংখলা বাহিনী তৎপর রয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি আরো জানান, বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে দ্রুতই উভয় পক্ষকে নিয়ে বসা হবে। আসাদুজ্জামান

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।