পৃথিবীতে মানব জাতির আগমনের প্রারম্ভ হতে অদ্যবধি যতো মানুষ পৃথিবীতে এসেছে, এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত আসবে সকল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (স.)। এটা আবেগ তাড়িত কোন বক্তব্য নয়। বরং পরীক্ষিত সত্য। তাঁর জন্মের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে পৃথিবীর অন্য কোন মানুষকে নিয়ে তেমনটি হয়েছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। সকল গবেষকের গবেষণা এবং সকল সমালোচকের সমালোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে তিনি সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। মহান আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে নিজেই বলেন “তোমাদের জন্য অবশ্যই রাসুলের (জীবনের) মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে” (সুরা আহযাবÑ ২১)। মহান আল্লাহ আরও বলেন,“নিসন্দেহে তুমি মহান চরিত্রের ওপর (প্রতিষ্ঠিত) রয়েছ” (সুরা আল কলাম Ñ৪)। আমাদের সকলের জানা দরকার তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণ গুলো।
প্রথমম : অধিকার আদায়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ :
দুধমাতা হালিমা (রা.) শত চেষ্টা করেও তাঁকে তাঁর দুটি স্তন কখনও পান করাতে পারেননি এ সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর মধ্যে ্এমন একটা অনুভুতি তৈরী করে দিয়েছিলেন যে তিনি বুঝতেন তাঁর আরও দুধভাই-বোন রয়েছে তিনি যদি একাই দুটি স্তন পান করেন তাহলে তাদের অভুক্ত থাকতে হবে। এ থেকে অন্যের অধিকার আদায়ের যে বাস্তব প্রশিক্ষণ তিনি অর্জন করেছেন তাঁর চর্চা তিনি ধরে রেখেছেন পরবর্তী জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে। ৬৩ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে দুধমাতা তাঁর স্বামী দুধভাই-বোন, চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোন নিজের একাধিক স্ত্রী সন্তান-সন্ততি লক্ষ লক্ষ সাহাবি আজমাইন (রা.) কেহ কখনও তাঁর বিরুদ্ধে অন্যের অধিকার হরণের কোন অভিযোগ তুলেছেন বলে ইতিহাসে কোন প্রমাণ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আল্লাহ বলেন “তোমাদের মাঝে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে আল্লাহ তায়ালাকে বেশি ভয় করে” (সুরা আল হুজুরাত Ñ ১৩)।
দ্বিতীয়ত: বিশ^ শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রসৈনিক :
রাসুল (স.) যে দেশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন সে দেশে তখন ছিল গোত্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা। গোত্রে গোত্রে অধিকাংশ সময় ঝগড়া ফাসাদ মারামারি লেগেই থাকত। তাঁর নিজ গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের এমনকি নিজ গোত্রের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন সংঘর্ষ হলেও তিনি কোন পক্ষ অবলম্বন করে অন্য পক্ষের ঊপর আক্রমণ করেছেন বলে কোন নজির এখনও কেঊ পেশ করতে পারেননি। বরং তিনি ছিলেন সকলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে। তাহলে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে তিনি যুদ্ধ করেছেন কেন? এ প্রশ্ন যারা করেন তাদের আমরা সরাসরি জবাব না দিয়ে বলব রাসুল (স.) এর জীবনে যে সমস্ত যুদ্ধ সংঘটিত হযেছে সেগুলো নিয়ে একটু নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করুন তাহলে আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারবেন তাঁর যুদ্ধগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিল না কি বিপক্ষে। উত্তরটা সহজে পেয়ে যাবেন আশাকরি। তিনি যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন তার বাস্তব প্রমাণ নিন্মাক্ত ঘটনা।“ রাসুল (স.) এর বয়স যখন পয়ঁত্রিশ বছর তখন কুরাইশগণ পবিত্র কা’বার ভবন সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত দেয়াল নির্মাণ সম্পন্ন হলে এবার তা (হাজরে আসওয়াদ) যথাস্থানে কে স্থাপন করবে তা নিয়ে ঝগড়া বিবাদ শুরু হলো। বর্ণিত আছে যে ঐ সময় সমগ্র কুরাইশ সম্প্রদায়ের প্রবীণতম ব্যক্তি আবু উমাইয়া ইবনুল মুগিরা নি¤œরুপ আহবান জানালেন, হে কুরাইশগণ, এই পবিত্র মসজিদের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি (আগামিকাল) প্রথম প্রবেশ করবে তাকেই তোমরা এই বিবাদের মিমাংসার দায়িত্ব দাও । সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। অতঃপর দেখা গেল, রাসুল (স.) সর্বপ্রথম প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে সবাই একবাক্যে বলে উঠল, এতো আমাদের আল-আমিন (পরম বিশ^স্ত) মুহাম্ম্দা। তাঁর ফায়সালা আমরা মাথা পেতে নেব। রাসুল (স.) বিবদমান লোকদের কাছাকাছি গিয়ে উপনীত হলে সবাই তাঁকে তাদের বিবাদের বিষয়টা জানালে তিনি বললেন, আমাকে একখানা কাপড় দাও। কাপড় দেয়া হলে তিনি তা বিছিয়ে হাজরে আসওয়াদ উক্ত কাপড়ের মধ্যস্থলে স্থাপন করে বললেন, প্রত্যেক গোত্রকে (গোত্রের সর্দার দের কে) এই কাপড়ের চারপাশ ধরতে হবে। সবাই তা ধরলো ও উঁচু করে যথাস্থানে নিয়ে রাখল। অতঃপর তিনি নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ তুলে যথাস্থানে রাখলেন ও তাঁর ঊপর গাঁথুনি দিলেন।”(সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃ: ৫০) এ ভাবে তিনি নিজ গোত্রকে রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষ হতে রক্ষা করলেন।
তৃতীয়ত: আদর্শ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মহানায়ক :
রাসূল (স.) শুধু একজন নবী ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক। মক্কার তেরটি বছর কেটেছিল দাওয়াত দান এবং কর্মীবাহিনী গঠনের কাজে। মদিনায় হিজরত করার পর তিনি সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠিকে একত্রিত করে মদিনা রাষ্টের গোড়াপত্তন করেন, যেটা ছিল একটি আর্দশ ও কল্যণ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনি সকল জাতি গোষ্ঠি, ধর্ম ,বর্ণের আদর্শ ও চিন্তা চেতনাকে সামনে রেখে ৪৭ অনুচ্ছেদ বিশিষ্ঠ একটা সংবিধান রচনা করেন যা ইতিহাসে “মদিনা সনদ” নামে পরিচিত। যেটা পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। রাসুল (স.) মৃত্যুর সময় মক্কা মদিনা সহ আশে পাশের বিস্তৃর্ণ এলাকার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তাঁর মৃতুর পর খোলাফায়ে রাশেদিন দীর্ঘ ৩০ বছর এ ধারা অব্যহত রাখেন। পরবর্র্তিতে ঊমাইযা ও আব্বাসিয় যুগে এসে কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয়। বর্তমান পৃথিবীর ৪৭টি সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম দেশের মধ্যে অনেক দেশে শতভাগ না হলেও রাসূল (স.) যে ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন তার অনেক ধারা এখনও বিদ্যমান ।
চতুর্থত: দক্ষ সেনা নায়ক :
রাসূল (স.) নিজেই বদর ,ওহুদ, খন্দক সহ অসংখ যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। যেটা পৃথিবীর অন্য কোন সেনা নায়কের দ¦ারা সম্ভব হয়নি।া
তাঁর যুদ্ধ পরিচালনার একটা বিশেষ ঘটনা যদি আমরা শুনি তাহলে বুঝতে পারব তিনি কতটা একনিষ্ঠতা সহকারে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। খয়বার যুদ্ধে যখন কামুস দূর্গ দখলের জন্য কিছুদিন যাবত যুদ্ধ চলছিল কোন ভাবে এটা দখলে আনা সম্ভব না হওয়ায় তখন তিনি ঘোষণা করেন, আগামীকাল আমি এমন একজন লোকের হাতে ইসলামের পতাকা দিব যার হাতে আল্লাহ কামুস দূর্গের পতন ঘটাবেন। পরবর্তিতে দেখা গেল তিনি পরের দিন হযরত আলি (রা.) এর হাতে পতাকা তুলে দিলেন এবং তাঁর হাতেই কামুস দূর্গের পতন হলো। এটা ছিল রাসূল (স.) এর রণ-কৌশলের সুনিপুণতা।
পঞ্চমত: সফল রাষ্ট্র নায়ক :
রাসুল (স.) মহান আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন । এবং সেখানে তিনি সকল জাতি ধর্ম-বর্ণের লোকদের একত্রিত করে মদিনা নামে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সর্বমোট ১০ বছর তিনি এ রাষ্ট্রের রাষ্ট প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি নতুন নতুন এলাকায় বিজয় লাভ করেন এবং সেগুলোকে মদিনা রাষ্টের অর্ন্তভুক্ত করেন। নতুন এলাকাগুলোতে সাহাবিদেরকে গভর্ণর নিযুক্ত করেন। সাহাবি আজমাইন (রা.) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ১০ বছর রাষ্ট্র পরিচলিনা করার পরও তাঁর বিরুদ্ধে কোন স্বজন প্রীতির এবং পক্ষপাতিত্ব মূলকভাবে বিচারকার্য সম্পন্ন করেছেন এমন অভিযোগ কখনও উত্থাপিত হয়নি। তিনি এ সময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত অহির দ্বারা শাসন কার্য পরিচালনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় রাসুল (স.) সর্বকালের সর্ব যুগের শ্রেষ্ট মানব। আমরা যদি দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালে মুক্তি আশাকরি তাহলে তাঁর আর্দশের অনুস্মরণ ও বাস্তবায়ন ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। আসুন আমরা এই শ্রেষ্ঠ মহামানবের জীবনী নিয়ে চিন্তাভাবনা গবেষণা করি এবং তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শগুলো দিধাহীন চিত্তে মেনে নেই। মহান আল্লাহ আমাদের মেনে নেয়ার তাওফিক দান করুন । আমিন।
মাওঃ মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম,
উপাধ্যক্ষ, গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা ,
অভয়নগর, যশোর।