ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান। মানুষের চুল ও দাড়ি পৌরুষের প্রতীক। এটি ইসলামী রীতিনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও বটে। ধর্মীয় বিধিবিধানের পাশাপাশি চুল ও দাড়ির রয়েছে স্বাস্থ্যগত ও বৈজ্ঞানিক নানা উপকারিতা। শুধু তাই নয়, বিশ্বনবী সা. তাঁর উম্মতকে জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগের ন্যায় চুল-দাড়ি পরিপাটিকরণের পদ্ধতিও শিখিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ সা. এর যাবতীয় আদর্শ মেনে চলাই একজন মুমিনের জন্য ওয়াজিব। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাসুল তোমাদের যা আদেশ দেন, তা গ্রহন করো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো, এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৭)
সুতরাং চুল ও দাড়ি রাখা নিয়ে রাসুল (সা.)-এর আদিষ্ট হাদিসগুলো উম্মতের জন্য আমল করা অপরিহার্য। এখানে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো:
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. গোঁফ নিশ্চিহ্ন করতে, আর দাড়ি বড়ো করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৬২৪) মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই চুলের সৌন্দর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্বাস্থ্যবান সুন্দর চুল শুধু সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না; বরং ব্যক্তিত্বের উপরও প্রভাব ফেলে। ইসলামে দাড়ির ন্যায় রয়েছে চুল পরিপাটি রাখার বিভিন্ন পদ্ধতি।
নিম্নে আমরা দাড়ি পরিপাটিকরণের বিবিধ বিষয়ে আলোচনা করবো। ইন শা আল্লাহ।
একজন মুসলিম সন্তানদের জন্ম পরবর্তী শিশুদের ক্ষেত্রে চুল ন্যাড়া করার বিধান ইসলামে প্রমাণিত (তিরিমিজী, আল-সুনান, ১৫২২)। চুল ন্যাড়া বলতে বুঝায় ‘হালক’ পদ্ধতি, যার অর্থ মাথার সমস্ত চুল ফেলে দেয়া। তবে শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে আরবে ‘কাজা’ নামক একটি পদ্ধতি প্রচলিত ছিলো, তা একেবারে নিষিদ্ধ করা হয় (আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৪১৪৭)। এটা হচ্ছে, মাথার কিছু অংশ মুন্ডন করা ও কিছু অংশ রেখে দেয়া। কপালের ওপরে কিছু চুল রেখে মাথার দু’পাশে চুল ফেলে দেয়া (বুখারী, আস-সহীহ, ৫৯২১)। ফলে বর্তমানে শর্ট কাট বা আন্ডার কাট, ক্লাসিক কাট, ফেড কাট, ক্রু কাট, বাজ কাট, লেয়ার স্পাইক, ইমো সুইপ ইত্যাদি সব ধরণের কাটিং-ই ইসলামে নিষিদ্ধ। তবে, হজ্জ ও উমরা পালনকারীর জন্য হালক কিংবা কসর দুই পদ্ধতির যে কোনো একটি করা আবশ্যক।
ইসলামে চুল কাটা বা রাখার ক্ষেত্রে একটি নিয়ম হলো, কানের লতি পর্যন্ত চুল রাখা, হাদীসের তাকে ‘ওয়াফরা’ (আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৪১৮৫) বলা হয়েছে। অন্যটি ‘লিম্মা’ পদ্ধতি তথা ঘাড় ও কানের লতির মাঝামাঝি পর্যন্ত চুল রাখা (আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৪১৮৭)। আরেকটি পদ্ধতির নাম ‘জুম্মা’ তথা ঘাড় পর্যন্ত চুল রাখা (আবু দাউদ, আস-সুনান, ৪১৮৩)। এ তিনটি পদ্ধতি আমাদের বাবরি পদ্ধতির সাদৃশ্যপূর্ণ। নবীজি সা. এ পদ্ধতিতে চুল রাখতেন-কাটতেন বলে হাদিস শরীফ থেকে জানা যায়।
মহানবীর সা. চুল মধ্যম প্রকৃতির ছিল; খুব কোঁকড়ানো নয়, আবার একেবারে সোজাও নয়। তা ছিলো দুই কাঁধ ও দুই কানের মাঝ বরাবর (মুসলিম, আস-সহীহ, ২৩৩৮)। তাঁর মাথার চুল দুই কানের অর্ধেক পর্যন্ত (মুসলিম, আস-সহীহ, ২৩৩৯) কিংবা লতি পর্যন্ত (আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৪০৭২) বা দুই কাঁধের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঝুলে থাকতো (বুখারী, আস-সহীহ, ৫৯০৩)। নবীজি সা. যেমন চুল ঝুলিয়ে রাখতেন, তেমনি মাথার দুই পাশের মাঝ বরাবর সিঁথিও কাটাতেন। সিঁথে কাটা ছিলো আরব মুশরিকদের পদ্ধতি আর ঝুলিয়ে রাখা ছিলো আহলু কিতাব ইহুদিদের পদ্ধতি। ইবন আব্বাসের রা. উপলব্ধি এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে নবীজিকে সা. কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে তিনি দু’টি পদ্ধতি-ই অনুসরণ করেছিলেন (বুখারী, আস-সহীহ, ৫৪৯২)। তিনি কখনো কলপ দেননি; তাঁর নিম্ন ঠোঁটের নীচের ছোট দাঁড়িতে এবং কানপট্টিতে আর মাথার মাঝে কিছু সাদা চুল ছিলো (মুসলিম, আস-সহীহ, ২৩৪১)।
ইসলামে চুল পরিপাটির ন্যায় দাড়ি রাখারও বিধান রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, তোমরা গোঁফকে কর্তন করো এবং দাড়িকে লম্বা করো। তোমরা অগ্নিপূজকদের বিপরীত করো। (মুসলিম, হাদিস : ৬২৬)
দাড়ি রাখার কিছু বৈজ্ঞানিক সুবিধাও আছে, ইউনানি চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে দাড়ি পুরুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। গলা ও বক্ষকে ঠা-া ও গরম থেকে রক্ষা করে। আধুনিক চিকিৎসাবিদদের একটি গবেষণায় জানা যায়, সব সময় দাড়িতে খুর চালালে চোখের শিরায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এতে চোখের জ্যোতি ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসে। আবার দাড়ি না রাখলে যৌনশক্তি হ্রাস পেতে থাকে। তা ছাড়া দাড়ি জীবাণুকে মুখের ভেতরে ঢুকতে প্রতিবন্ধতার সৃষ্টি করে। তাই দাড়ি সেভ করা তথা মু-ন করা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং সুন্নাতের খেলাফ।
তবে, চুল কাটা-ছাঁটার ব্যাপারে নারীদের ক্ষেত্রে হলক পদ্ধতি ইসলামে নিষিদ্ধ (নাসাঈ, আস-সুনান, ৫০৪৮)। হজ্জ ও উমরায় নারীদের ক্ষেত্রে হালক নেই; তারা শুধু কসর পদ্ধতি অনুসরণ করবে (আবূ দাউদ, আস-সুনান, ১৯৮৫)। তাদের সমগ্র মাথার চুল একত্রে ধরে এক আঙুল পরিমাণ কাটতে হবে (সাইয়িদ সাবিক, ফিকহুস্সুন্নাহ , খ. ১, পৃ. ৭৪)। নারীরা একমাত্র স্বামীর জন্য সজ্জিত ও পরিপাটি করে তুলবার জন্য চুল ছোট করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে নবীজির স্ত্রীদের থেকে ‘ওয়াফরা’ পদ্ধতির সদৃশ হওয়া প্রমাণিত হয়েছে (মুসলিম, আস-সহীহ, ৩২০)। কারো মতে, ওয়াফরা পদ্ধতিতে চুল কাঁধের একটু নীচে থাকে। কারো কারো মতে, চুল কানের লতি পর্যন্ত পৌঁছায়।
বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থীরা যেভাবে চুল ছাঁট করছে (কিছু কিছু ক্ষেত্রে) তা ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে সুন্নাহ’র পরিপন্থী। আমাদের পুরুষদের উচিত এ ক্ষেত্রে আমাদের নবীজিকে সা. আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা এবং আমাদের নারীদের উচিত এ ক্ষেত্রে নবীজির স্ত্রী-কণ্যাদেরকে রা. আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা। তা না হলে এবং স্রোতে গাঁ ভাসিয়ে চললে সমাজ ও সভ্যতার বড়ো বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে না।
বিলাল হোসেন মাহিনী
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর যশোর।