চার দিকে সবুজের সমারোহ। রোপা আমন ধানক্ষেতের সবুজ দৃশ্যের মাঝে মাঝে সোনালি রঙ দেখা যাচ্ছে দূর থেকেই। ধান পেকেছে। কৃষকরা এই ধান কাটাও শুরু করেছেন কিছুদিন আগে থেকে। জানা গেল এই পাকা ধানের নাম বিনা-১১। মাঠে যখন প্রচলিত ধানগুলোর এখনো থোরই হয়নি, তখন এই ধান কাটা শুরু করেছেন চাষিরা। এটি ময়মনসিংহ সদর থেকে ১৫-১৬ কিলোমিটার দূরের ছাতিয়ানতলা গ্রাম। ব্রহ্মপুত্রের তীরে, চর এটি। এক সময় ছাতিয়ানতলাসহ ওই এলাকার কয়েকটি গ্রাম ব্রহ্মপুত্রেরই অংশ ছিল।
কালের বিবর্তনে নদের গতিপথ পরিবর্তন আর ভাঙ্গা-গড়ায় নদীতে পলি জমে সমতলে পরিণত হয়েছে। এখন ওই এলাকায় যেমন বসতি বেড়েছে, তেমনি একসময়ের বালুময় জমিতে ধানের ফলন হচ্ছে। কথা হলো স্থানীয় পেশ ইমাম মাওলানা আবু সাঈদের সাথে। তিনি বলেন, গত বছর বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্মকর্তাদের পরামর্শে পরীক্ষামূলকভাবে বিনা ধান-১১ চাষ করেছিলাম। বিঘায় ১৬ মণ ফলন হয়েছে। এবার দুই বিঘায় আবাদ করেছি। অন্যরাও আমার দেখাদেখি উৎসাহিত হয়ে এই ধান চাষ করেছে। কারণ অন্য ধানের চেয়ে বিনা-১১ এর ফলন ভালো। অল্প দিনেই ঘরে তোলা যায়। আবু সাঈদ জানান, আমাদের এই এলাকাটি বন্যাপ্রবণ। বোরো ধান কাটার পর প্রচলিত আমন ধান লাগিয়ে থাকেন কৃষক। বোরো আর আমন ধান ছাড়া বছরে অন্য কোনো ফসল হতো না। কিন্তু এখন আরেকটি ফসল চাষ করতে পারছি। এই বিনা ধান (আমন) কাটার পরই সরিষা চাষ করব। সরিষা তোলার পর আবার বোরো ধান রোপণ করব।
একই গ্রামের কৃষক আবু বকর জানান, আমাদের এলাকাটি এমনিতেই চর বা বালুমাটির জমি। বোরোর ফলন মোটামুটি বেশি হলেও আমন মওসুমে প্রচলিত যেসব ধান রয়েছে, সেগুলোর ফলন আশানুরূপ নয়। বিনা ধান বালু জমিতেও ভালো ফলন হয়। সবচেয়ে বড় কথা- যেহেতু এলাকাটি নিচু, তাই বিনা ধান তলিয়ে গেলেও নষ্ট হয় না। দুই ফসলের জায়গায় তিন ফসল করতে পারছি আমরা।
বিনা সূত্রে জানা যায়, শুধু ময়মনসিংহ নয়, মঙ্গাপীড়িত রংপুরের বিভিন্ন এলাকা, বরেন্দ্রভূমিসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে জলমগ্নতাসহিষ্ণু, উচ্চফলনশীল ও আগাম আমন ধানের জাত বিনা ধান-১১ চাষ হয়েছে। এতে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। বিনা জানায়, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের কৃষি খাতে দৃশ্যমান অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশে প্রতি বছর অতি বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা ও বন্যায় প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমির ধান কোনো না কোনোভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আকস্মিক বন্যা, অতি বন্যা, জোয়ারের বন্যা, পাহাড়ি ঢলের বন্যার কারণে আবাদি জমি ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে রোপা আমন মওসুমের চাষাবাদকৃত ধানের জাতগুলো নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। আকস্মিক বন্যার মধ্যেও আমন ধানের ফলন অপরিবর্তিত রাখার জন্য বিনার বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন জলমগ্নতাসহিষ্ণু ধানের জাত বিনা-১১। আমনের এই জাতটি ২০-২৫ দিন জলমগ্নতা সহ্য করার পরও বন্যা আক্রান্ত জমিতে হেক্টরপ্রতি পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টন এবং বন্যামুক্ত স্বাভাবিক জমিতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। আমন মওসুমে এই জাতটির জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন। তা ছাড়া স্বল্প জীবনকাল বিশিষ্ট হওয়ায় এই জাতটি চাষাবাদ করে সহজেই শস্য নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব।
বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম জানান, আগের আমন জাতগুলোর জীবনকাল বেশি হওয়ায় উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা বছরে দু’টির বেশি ফসল চাষ করতে পারতেন না। নতুন শস্য বিন্যাসে ময়মনসিংহসহ আশপাশের জেলার কৃষকেরা আগাম আমন- সরিষা/পাটশাক/রবি ফসল-বোরো চাষ করছে। তা ছাড়া স্বল্প জীবনকালবিশিষ্ট এ সব জাতের ধান চাষাবাদ করে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য জেলার কৃষকরা দুই ফসলি জমিকে তিন-চার ফসলি জমিতে রূপান্তর করেছে। উত্তরাঞ্চলে আমন কাটার পর কৃষকরা সহজেই একবার বা দুইবার আলু চাষ করে থাকে। নতুন শস্য বিন্যাসে আগাম আমন চাষের পর সরিষা এবং পরে বোরো করতে পারছে বা আরো কোনো ফসল চাষ করার সুযোগ রয়েছে। এতে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়ে বছরে তিন-চারটি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। বিনা ১১ চাষের ফলে উত্তরাঞ্চলের মরা কার্তিক বা মঙ্গা চিরকালের জন্য দূরীভূত হয়েছে। সর্বোপরি দেশের টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিনা-১১ বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
বিনার ডিজি বলেন, স্থানীয় জাতের চেয়ে বিনা-১১ চাষে সার, পানিসহ বিভিন্ন খরচ ৩০ শতাংশ কম লাগে। চারা রোপণ থেকে কাটা পর্যন্ত ১১০-১২০ দিন লাগে। নিচু জমি বা যেসব জমিতে পানি জমে থাকে সেখানে এই ধানচাষ উপযোগী। কারণ বিনা-১১ পানির নিচে ২০-২২ দিন থাকলে এমনকি পানিতে তলিয়ে পচে গেলেও শুকানোর পর ধানের গোড়া থেকে ফের ডগা বা পাতা গজায়। অর্থাৎ নতুন করে ধান রোপণ করতে হয় না। তিনি আরো বলেন, দেশে প্রায় ৫২ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে বিনা-১১ জাতটি চাষ হয়েছে ছয়-সাত শতাংশ জমিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রতিনিয়ত আবাদি জমি কমছে। বাড়ছে মানুষ। তাই দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য যেমন উচ্চফলনশীল ধান হওয়া প্রয়োজন, তেমনি এক জমিতে যাতে তিন-চারবার ফসল ফলানো যায় সেদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আমন ধান বিনা-১১ জাতটি যেহেতু আগাম জাত ও বন্যাসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল, তাই এই জাতটি কৃষকের মধ্যে জনপ্রিয় করতে হবে। সেক্ষেত্রে বিনা-১১ জাতটির বীজ কৃষক পর্যায়ে সহজভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়া প্রয়োজন।