আবার মামলা ও গ্রেফতার জালে বিএনপি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন সাত শতাধিক। এসব মামলায় আসামি এবং গ্রেফতারকৃত বেশিরভাগই বিএনপির নেতাকর্মী।
অনেকে গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকা ছাড়া। শুধু তৃণমূল নেতাকর্মী নন, কেন্দ্রীয় একাধিক নেতাও আছেন গ্রেফতার আতঙ্কে। এদিকে মঙ্গলবার নয়াপল্টনে সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় আটক করা হয়েছে অর্ধশত নেতাকর্মীকে। এ ঘটনায়ও মামলা এবং অনেককে আসামি করা হবে এমন শঙ্কা আছে। সবমিলিয়ে বিএনপিকে নতুন করে চাপে ফেলার জন্যই এসব করা হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
এবার দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার নানুয়া দীঘিরপাড়ে অস্থায়ী মণ্ডপে কুরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে ১৩ অক্টোবর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়। পরে তা চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। ঘটনার পর থেকে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শুরু হয় দোষারোপের রাজনীতি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ইন্ধনদাতা হিসাবে বিএনপিকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। অন্যদিকে সরকারের মদদেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে দাবি বিএনপির।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানায় বিভিন্ন সংগঠন। সরকারও এ ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নেয়। পেছনের ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করতে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় এ পর্যন্ত ১২৩টি মামলায় প্রায় ২০ হাজার লোককে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন সাত শতাধিক।
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী জানান, তারা আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে করেছে দলটির হাইকমান্ড। ওইসব বৈঠকের মতামত নিয়ে একটা খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তা নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতও নেবে বিএনপি। এরপর চূড়ান্ত করা হবে আন্দোলনের রূপরেখা। পাশাপাশি সারা দেশে তৃণমূল পুনর্গঠনেও ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দল গোছানোর কাজও শুরু হয়েছে।
দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি যখন আন্দোলনের প্রস্তুতি ও দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে ঠিক সেই মুহূর্তে নেতাকর্মীদের আবার মামলা জালে আটকানোর জন্য সরকার পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে।
কারা এ সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই নেতাকর্মীদের নামে দেওয়া হয়েছে মামলা। অনেক এলাকায় মামলার আগেই নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপিকে জড়ানোর কৌশল হিসাবে অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। যাদের নামে মামলা নেই তাদেরও আটক করে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে।
জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বর্জন করছে বিএনপি। কিন্তু ধানের শীষ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে স্থানীয় নেতারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। যেসব এলাকায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে সেখানে ইউপি নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের এসব মামলায় জড়ানো হচ্ছে। গ্রেফতারের ভয়ে নির্বাচন ছেড়ে অনেকে আত্মগোপনে। গ্রেফতার এড়াতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন। যারা বাড়িতে আছেন তারাও রাতে ঘরে ঘুমাতে পারছেন না। তৃণমূলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের তালিকা করে তাদের বাসায় প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে ক্ষমতাসীনদের মদদ রয়েছে। সরকারের এজেন্টরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েক জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গ্রেফতারও হয়েছেন। কিন্তু নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে তারা এখন বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, সরকার একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। নানা ব্যর্থতা আড়াল ও বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসাবে তারা বিভিন্ন এজেন্ট দিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে। ঘটনার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে মামলা এবং তাদেরকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে সরকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মামলার জালে জড়িয়ে অনেক নেতাকর্মীই বাড়িছাড়া।
মির্জা ফখরুল বলেন, মামলা ও গ্রেফতার জালে বিএনপিকে বন্দি করার কৌশল আওয়ামী লীগের বেশ পুরোনো। এর আগেও সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে তারা মামলাকে বেছে নেয়। এসব মামলার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। বিএনপিকে নির্মূল করাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য।
সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে তৃণমূলের পাশাপাশি বিএনপির কেন্দ্রীয় কয়েক নেতাও নজরদারিতে রয়েছেন। ঘটনার ইন্ধনদাতা হিসাবে তাদেরও গ্রেফতার করা হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। কুমিল্লার ঘটনার পর দলের কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমানকে জড়িয়ে একটা অডিও ভাইরাল করা হয়। যদিও ওই অডিওকে মিথ্যা বানোয়াট এবং সুপার এডিটেড বলে দাবি করেছে বিএনপি। এদিকে নোয়াখালীর সংঘর্ষের ঘটনায় ইতোমধ্যে ২৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেককে নেওয়া হয়েছে রিমান্ডে। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম দাবি করেন, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে বিভিন্ন মন্দিরে হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি ফয়সাল ইনাম কমল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস-চেয়ারম্যান বরকতুল্লাহ বুলুসহ বিএনপি-জামায়াতের ১৫ নেতার সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন।
পুলিশের এমন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বরকতুল্লাহ বুলু। যুগান্তরকে তিনি বলেন, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা পেছনে সরকারের ইন্ধন রয়েছে। তারা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর কৌশল হিসাবে এখন বিএনপিকে এসব ঘটনায় জড়ানোর ষড়যন্ত্র করছে। অথচ ঘটনার পর আমাদের নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মিলে দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করেছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেককে আশ্রয় দিয়েছে। যারা সহিংসতা নিরসনে মাঠে ছিলেন সেসব নেতাকর্মীর নামে উল্টো মামলা দেওয়া হয়েছে। সেজন্যই আমি শুরু থেকেই এ ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে বিএনপিকে ঘায়েলে মনগড়া তত্ত্ব প্রকাশ করছে। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে সরকারের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন এসব করছে বলে দাবি করেন তিনি।
বিএনপির অভিযোগ, মামলার জালে আটকানো সরকারের পুরোনো কৌশল। মামলা দিয়ে বিএনপিকে কাবু রাখতে চায় সরকার। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীর নামে এক লাখ সাত হাজার মামলা দিয়েছে। এসব মামলায় ৩৫ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের প্রায় সব নেতাই এসব মামলার আসামি। কারও কারও বিরুদ্ধে শতাধিক মামলাও রয়েছে। এখনও এসব মামলায় অনেকে কারাগারে। মামলায় হাজিরা দিতে প্রায় প্রতিদিন কেন্দ্রীয়সহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। কেউ কেউ পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেক মামলার বিচারও শুরু হয়েছে। আবার পুরোনো অনেক মামলায় নেতাদের নামে পরোয়ানাও জারি হচ্ছে। সোমবার দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর কিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ২০১৮ সালের একটি মামলায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত এ পরোয়ানা জারি করেন। আগামী নির্বাচনে অনেক নেতাকে অযোগ্য করতে সরকার এসব মামলা দ্রুত শেষ করতে চায় বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।