কেমন আছেন নিজের বাইক পোড়ানো সেই পাঠাওচালক। নিশ্চয় অনেকের মনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি কী করছেন, কোথায় আছেন, কেউ কি তাকে বাইক কিনে দিয়েছেন-এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আলোচিত বাইকচালক সোহেলের মুখোমুখি হয় যুগান্তর। তার মুখেই শোনা যাক সেসব উত্তর। ৩১ অক্টোবর শওকত আলী সোহেলের সাক্ষাৎকার নেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তোহুর আহমদ
বাইকচালক শওকত আলী সোহেল খেটে খাওয়া সাধারণ পরিবারের সন্তান। পাঠাও অ্যাপে ভাড়ায় বাইক চালানো তার পেশা ছিল না। ছিল ছোটখাটো স্যানেটারি সামগ্রীর দোকান। কিন্তু দফায় দফায় করোনা মহামারির ভয়াল আঘাত তার সীমিত আয়-রোজগারের এই পথকে রুদ্ধ করে দেয়। একপর্যায়ে সংসার চালানোর দায় থেকে যুক্ত হন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘পাঠাও’-এ। রেজিস্ট্রেশন করেন। নিজের প্রায় এক যুগের প্রিয় মোটরসাইকেল নিয়ে নেমে পড়েন ঢাকার রাজপথে।
কিন্তু বিধি বাম। সেখানেও বিপত্তি। সারা দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা উপার্জন হয়, এর একটা অংশ কমিশন বাবদ নিয়ে যায় পাঠাও অ্যাপ কর্তৃপক্ষ। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালানো ছিল কষ্টকর। কিন্তু ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেয় ট্রাফিক পুলিশের অহেতুক হয়রানি। রাস্তায় নামলেই যেনতেন অজুহাতে মামলা। মামলা দিলেই খসে যায় নিদেনপক্ষে ১ হাজার টাকা, যা বিক্ষুব্ধ সোহেলের জীবনকে আরও বিষিয়ে তোলে।
এই যখন অবস্থা, তখন ফের মামলা দিতে ট্রাফিক পুলিশ তার গতিরোধ করলে তিনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রতিবাদ জানানোর নিয়মতান্ত্রিক সব ভাষা ভুলে নিজের প্রিয় মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। দিনটি ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর। মুহূর্তেই খবরটি ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুনের ভিডিও। টক অব কান্ট্রি নয়, বাংলা ভাষাভাষী সব বাঙালির কাছে এই প্রতিবাদ ঘুণে ধরা সমাজের বড় এক প্রতীকী প্রতিবাদ হয়ে ধরা দেয়।
এ বিষয়ে যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সোহেলের মূল বক্তব্য ছিল-‘ট্রাফিক পুলিশ কিংবা অন্য কাউকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। প্রয়োজন কার্যকর পরিবর্তন। সিস্টেমের পরিবর্তন। এই পরিবর্তন দরকার সব ধরনের অন্যায়ের ক্ষেত্রে। এটি যতক্ষণ না হবে, ততক্ষণ বাস্তবিক অর্থে কোনো কিছুরই সমাধান হবে না।’
যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সোহেল জানান, ১৯৮৯ সাল থেকেই ছোটখাটো ব্যবসা করেন। সঙ্গে স্যানিটারি পণ্যের দোকান ছিল তার। কিন্তু করোনা মহামারিতে সব ওলটপালট হয়ে যায়। গত বছর মার্চে লকডাউন শুরু হলে তার দোকান বন্ধ হয়ে যায়। জমানো টাকা ভাঙিয়ে কিছুদিন সংসার চললেও যৎসামান্য সঞ্চয় ফুরিয়ে আসে। উপার্জনের বিকল্প আর কোনো পথ ছিল না। শেষে নিজের মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় নামেন। পাঠাওচালক হিসাবে নাম নিবন্ধন করে শুরু করেন ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণ। সোহেল বলেন, ‘ঢাকায় বাইক চালানোর ১৪ দিনের মাথায় ট্রাফিক পুলিশ প্রথম মামলা দেয়। তারিখটা ঠিক মনে নেই। তবে পুলিশ মামলা দেয় চুক্তিতে যাত্রী নেওয়ার কারণে। সার্জেন্টকে বললাম, চুক্তিতে যাত্রী নেওয়া কি বেআইনি? সার্জেন্ট আইনের ধারা দেখিয়ে বলে, হ্যাঁ। বললাম, এ আইন কখন হলো (!) আমরা তো জানি না। তাহলে মামলা দেবেন কেন? কিন্তু তিনি কোনো কথা শুনতে রাজি নন। মামলার কাগজ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন পুলিশ সার্জেন্ট।’ তিনি জানান, ‘সারা দিন বাইক চালিয়েও ৮০০ টাকার বেশি রোজগার করা যায় না। কিন্তু একটা মামলার কাগজ তুলতে দুই হাজার টাকা চলে যায়। ২৮ দিনের মাথায় বাড্ডা লিংক রোডে ফের গাড়ির কাগজ নেয় পুলিশ। আরেকটি মামলা দেওয়ার কথা বলে। সার্জেন্ট এসে বললেন, কাগজ দে। বললাম অপরাধ কী? সার্জেন্ট শুধু বললেন রং পার্কিং। মামলা হবে। অনেক অনুরোধেও সার্জেন্টের মন গলেনি।’
সোহেল বলেন, ‘তখন বুঝতে পারলাম ঢাকায় বাইক চালালে পুলিশের এই মামলা জাল থেকে রেহাই মিলবে না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়ে ফেললাম। বাইক থেকে তেলের লাইন খুলে দিলাম আগুন। আগুন নেভাতে আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসে। কিন্তু আমি কাউকে আগুন নিভাতে দিইনি।’ চোখের সামনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে টিভিএস ফ্লেম মডেলের বাইকটি, যা ছিল তার ১১ বছরের প্রিয় সঙ্গী।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সোহেল বলেন, ‘যে রং পার্কিংয়ের জন্য পুলিশ মামলা দেয়, বলেন তো কোন জায়গাটায় পার্কিং আছে। সব জায়গা তো নো পার্কিং জোন। অথচ মতিঝিলে শ শ গড়ি রাস্তায় পার্কিং করা আছে। কই সেখানে তো কোনো মামলা হয় না। তাহলে বাইকচালকদের ওপর এত জুলুম কেন। এর জবাব কে দেবে?’ তিনি বলেন, ‘রাইড শেয়ারিংয়ের নীতিমালা করা হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু নীতিমালা কাদের জন্য, রাইডারদের সঙ্গে কথা বলে নীতিমালা করা হয়েছে? হয়নি। তাহলে এই নীতিমালা করে লাভ কী। বলা হচ্ছে, নিরাপত্তার জন্য অ্যাপে চলা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। কিন্তু বলেন তো, হাজার হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক-যাত্রীর নিরাপত্তার জন্য কোনো অ্যাপ আছে? পেশাদার চালকদের তালিকাভুক্তির নিয়ম চালু হয়েছে। অথচ তাদের পরিচয়পত্র দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা চালু নেই। তাহলে কে পেশাদার আর কে পেশাদার নন, তা বুঝবেন কীভাবে। আসলে বিষয়গুলো ক্লিয়ার না। দেখার কেউ আছে বলে মনে হয় না। কেউ প্রতিবাদও করে না।’
নিজের বাইকে আগুন দিয়ে তিনি প্রতিবাদ করতে গিয়েও বাধা পেয়েছেন। তাকে চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। এজন্য এখন তিনি খোলাখুলি সব কথা বলতে চান না। তবে এতকিছুর পরও তিনি পুলিশকে দোষ দিতে চান না।
সোহেল বলেন, ‘আসলে ট্রাফিক সার্জেন্টের কোনো দোষ নেই। সিস্টেমই ঠিক নেই। কোথাও স্বচ্ছতা নেই। পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি। রাইড শেয়ারিং নীতিমালার মধ্যে অসংগতি আছে। অ্যাপে না গেলেই মামলা। অথচ সবকিছুতেই রাইডারের বিনিয়োগ। বাইক, জ্বালানি, মেরামত সবকিছুই বাইকচালকের। এছাড়া রয়েছে সময় ও শ্রম। সর্বোপরি জীবনের ঝুঁকি। কিন্তু অ্যাপ কোম্পানিগুলো কী এসবের ভাগ নেয়? নেয় না। কিছুদিন আগে মগবাজারে একজন চালক মারা গেলেন। এক টাকাও কি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় চলতে গিয়ে পুলিশের হাতে অনেক রাইডার নির্যাতনের শিকার হন। হাতিরঝিলে এক রাইডারকে মারধরের ভিডিও এখনো ইউটিউবে আছে। এর কি কোনো বিচার হয়েছে?’
সোহেলন জানান, তার প্রতিবাদকে ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অনেকে আন্দোলন চায়। এমনকি পরিবহণ নেতাদের অনেকে তাকে বাহবা দেওয়ার নামে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছেন। কথার মারপ্যাঁচে ফেলতে চায় অনেকে। তিনি বলেন, ‘আমি নাকি হতাশাগ্রস্ত। ঋণের কারণে বাইক পুড়িয়েছি। এসব একদম ঠিক না। আমি শুধু পুলিশের মামলা থেকে রেহাই পেতে নিজের বাইকটা পুড়িয়ে দিয়েছি। এর বেশিকিছু না।’
এক প্রশ্নের জবাবে সোহেল জানান, বাইক পোড়ানোর পর অনেকেই নতুন বাইক কিনে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি কারও বাইক নিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমি তো আর বাইক চালাব না। তাহলে বাইক নিয়ে কী করব। এরপরও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানি নাছোড়বান্দা। তিনি নতুন বাইক নিয়ে আমার গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির। তাই বাইকটা রাখতে বাধ্য হয়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শওকত আলী সোহেল বেশিদূর পড়ালেখা করেতে পারেননি। দরিদ্র পরিবারে কিশোর বয়সেই সংসারের ভার আসে তার কাঁধে। ফলে এসএসসির গণ্ডি পার হতে পারেননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের পিতা। স্ত্রী এবং মাকে নিয়ে তার ৬ জনের সংসার। প্রতিমাসে ন্যূনতম খরচ ৩০ হাজার টাকা। বাইক পোড়ানোর পর এখন উপার্জনের কানাকড়িও নেই। সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে, তা-ও জানা নেই।
ট্রাফিক পুলিশ যা বললেন : বাইক পোড়ানোর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে গুলশান ট্রাফিক বিভাগ। সংশ্লিষ্ট দুই সার্জেন্ট দেবব্রত বড়ুয়া এবং মাহবুবুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু বিভাগীয় তদন্তে তারা শেষ পর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণিত হন। গুলশান ট্রাফিক ডিভিশনের এডিসি এবিএম জাকির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা পাঠাওচালকের বাইক পেড়ানোর ঘটনা তদন্ত করে দেখেছি সেখানে সার্জেন্টদের কোনো দোষ ছিল না। তাকে মামলাও দেওয়া হয়নি। অথচ হঠাৎ তিনি উত্তেজিত হয়ে বাইকে আগুন দিয়েছেন। তবে পাঠাওচালকদের অনেকেই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বাইক চালাচ্ছেন। কিন্তু আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে সার্জেন্টদের প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সোমবার নতুনবাজার ট্রাফিক বক্সে দায়িত্ব পালন করছিলেন সার্জেন্ট দেবব্রত বড়ুয়া। এ সময় তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ঘটনাটি অনাকাক্সিক্ষত। সোহেলকে মামলা দেওয়া হয়নি। অথচ তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বাইকে আগুন লাগিয়ে দেন।’ তিনি জানান, রাস্তায় ট্রাফিক আইন মানাতে গিয়ে তারা নানা ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। অনেকেই আইন মানতে নারাজ। আবার মামলা দিলে পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
অপর সার্জেন্ট মাহবুবুর রহমান বলেন, তার সঙ্গে কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু তিনি কেন এমন আচরণ করলেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। বাইকে আগুন দিতে অনেকেই তাকে বাধা দেয়। কিন্তু তিনি কারও বাধা শোনেননি। হয়তো ভাইরাল হওয়ার জন্য পূর্বপরিকল্পিতভাবে তিনি এটা করেছেন।