আবু সাইদ বিশ্বাস: উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ফিরে: জলবায়ু-পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়ে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। পিতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে অনত্র আশ্রয় নিচ্ছে অসংখ্য মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন আর সমুদ্রপৃষ্টের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অসংখ্য মানুষ বাস্তচ্যুত হচ্ছেন। একের পর এক গ্রাম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কৃষি, জনস্বাস্থ্য, বাসস্থান, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে নানামূখি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন এখনও পানির নিচ থেকে উঠে দাঁড়ায়নি। সুপার-সাইক্লোন আম্ফান ও বেড়ি বাঁধ ভাঙ্গনে সেখানে বন্যা সৃষ্টি হয়। সেই পানিতেই আটকে আছেন তারা। প্রায় দেড় বছর ধরে তারা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতেই এ সংকট আরো তীব্র আকারে দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য এই সংকট মোকাবেলায় কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে না পারলে উপকূলীয় অঞ্চলে কোটি মানুষ বাস্তচ্যুত হয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে বিশেজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলেছে, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তিন লাখ মানুষ। স্থানীয় এনজিও লোকাল এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট এন্ড এগ্রিকালচারাল রিসার্স সোসাইটির এক জরিপ মতে, এখনও বাস্তুচ্যুত ৫০ হাজার মানুষ। আম্ফানের পর এসব মানুষ সরকারি জমিতে বসবাস করছেন। না হয় নদীর পাড়ে বসবাস করছেন। না হয় সড়কের পাশে। অনেক মানুষ পাশের কোনো গ্রামে অথবা শহরে চলে গিয়েছেন।
কুড়িকাহনিয়া গ্রামের শাহজাহান মোড়ল (৪৫) বলেন, আমি কৃষিকাজ করতাম। ধান লাগাতাম। তাতে ভাল ধান হতো। কিন্তু সেইসব জমি এখন পানির নিচে। এখন সেই ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে নৌকা চালাই। নৌকায় যাত্রী পরিবহন করে দেই একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে তাতে ১০০ থেকে দেড়শ টাকা আয় হয়। এত কম উপার্জন দিয়ে পরিবার চালাতে পারি না।
বার বার প্রাকৃতিক দুযোগের কারলে কারণে ১৯৬০ এর দশকে তৈরি করা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কুড়িকাহনিয়া গ্রামের আবদুস সাত্তার গাজী বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে আসছি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। প্রাকৃৃতিক দুর্যোগ আসে। আর আমরা নিঃস্ব হই। এভাবেই আমরা বেঁচে আছি। যদি শক্তিশালী বাধ থাকতো তাহলে এই সমস্যা হতো না। তিনি ও তার স্ত্রী জাহেরা খাতুন যে বাড়িতে বসবাস করেন তা একেবারেই নদীর কিনারে।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনিস্টিটিউটের প্রকাশিত জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৩৬ বছরে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ২ হাজার দশমিক ৮১ হেক্টরে। বৃদ্ধির হার শতকরা ২৬.৭ ভাগ। ১৯৭৩ সালে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ লাখ ৩৩ হাজার দশমিক ৪৫ হেক্টর। ২০০০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ২০ হাজার দশমিক ৭৫ হেক্টর। মাত্র এক যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ২০০৯ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার দশমিক ২৬ হেক্টর, অর্থাৎ ৯ বছরে বাড়ে ৩৫ হাজার দশমিক ৫১ হেক্টর ( বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ)। ২০২০সালে এসে তা দাঁড়ায় ১২ লাখ হেক্টরের কাছা কাছি।
দেশের উৎপাদিত খাদ্যের এক বিরাট অংশই ফলতো উপকূলীয় এই এলাকাগুলোতে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ওইসব অঞ্চলে কৃষি আবাদ ব্যাহত হওয়ায় দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি গবেষণার মাধ্যমে লবণসহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণ করে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন এখনো খুবই সীমিত পরিসরে রয়েছে। সার্বিক সংকট মোকাবেলায় অভিযোজন কৌশল এই মুহুর্তেই বড় কোনও ভূমিকা রাখতে পারছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ঋতুর বৈচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা ইত্যাদি বাড়ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা,খুলনা,বাগেরহাটসহ উপকূলীয় কয়েকটি জেলায় এর প্রভাব মারাত্সক আকার ধারণ করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড ডেভেলপমেন্ট-কর্তৃপক্ষ বলেছেন, আমরা দুর্যোগের আগে লাখ লাখ মানুষকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি। এতে প্রচুর মানুষের জীবন রক্ষা করা গেছে। কিন্তু মানুষজন এখনও তাদের বাড়িঘর, জমিজমা ও জীবিকা হারাচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড়ের পরে সহায়তায় ঘাটতি আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিম্ন উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষগুলো জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ধীরে ধীরে তাদের জীবনজীবিকা হারাচ্ছেন। কৃষক, জেলে তাদের কাজ হারিয়ে বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (এক্সটেনশন)-এর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বিগত ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পান পরবর্তী ২জুন একনেকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতা নিরসনে জরুরীভাবে ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ ১৬ হাজার টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেন। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, বরাদ্দের টাকা আগামী ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থ বছর পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদী এই প্রকল্প পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের কাজ চলমান থাকবে। বরাদ্দকৃত টাকার মধ্যে ২০-২১ অর্থ বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প শুরু হয়। এরমধ্যে সদরের ফিংড়ী ইউনিয়নের ফিংড়ী, এল্লারচর ও ভোমরা এলাকায় ৯ কিলোমিটার ৪০০ মিটার বেড়িবাধ নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়। এছাড়া এবছর আরো ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয় উল্লেখ করে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রধান প্রধান কার্বন নির্গমনকারী উন্নত দেশগুলোর উচিত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনে সাড়া দেয়া। উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই তাদের প্রতিশ্রুতি ১শ’ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল ছাড় দেয়া এবং এটি বাস্তবায়ন করা উচিত। তিনি বলেন,জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবের সম্মুখীন বাংলাদেশ।
আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ০৪/১১/২০২১
০১৭১২৩৩৩২৯৯/০১৯৭২৩৩৩২৯৯
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …