আবু সাইদ বিশ্বাস: উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ফিরে: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে হুমকিতে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, নদী তীরবর্তী এলাকার বেড়িবাঁধ ভাঙন, সুপেয় পানির সমস্যা, শিশু মৃত্যু, নারীর প্রজনন, খাদ্য সংকট, অসংখ্য প্রাণী বিলুপ্তসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস করেন উপকূল অঞ্চলে, যাদের জীবিকার প্রধান উপাদান কৃষি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে এ ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চল।
সমুদ্রপৃষ্টে উচ্চতা বৃদ্ধি, উজানে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অনিয়িন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, জলোচ্ছ্বাস ও উচ্চ জোয়ারের মাত্রা বৃদ্ধি, উপকূলীয় পোল্ডারগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূলত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে। বর্তমানে ১৯টি উপকূলীয় জেলার ১৫৩ উপজেলায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের বাস। যার মধ্যে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষ অতি দরিদ্র।
সাতক্ষীরা অঞ্চলে ষাটের দশকে ওয়াপদার বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে গোটা এলাকায় কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। সবুজ গাছপালায় উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় মিনি অরণ্যে। ওই সময় প্রতিটি বাড়িতে ছিল গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান। এলাকার চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো।একপর্যায়ে আশির দশকে এ অঞ্চলে শুরু হয় পরিবেশ বিধ্বংসী লবণ পানির চিংড়ি চাষ। বর্তমানে শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, আশাশুনি, সদর ও তালা উপজেলায় প্রায় অর্ধলক্ষাধিক হেক্টর জমিতে সাদা সোনা খ্যাত লবণাক্ত পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয় ও লবণ পানির আগ্রাসনে এ অঞ্চলে হ্রাস পেয়েছে কৃষিজমি। গত দুই দশক ধরে ধরে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ষাটের দশকে নির্মিত বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত জোয়ারের উপচেপড়া পানিতে প্লাাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। অসংখ্য নদ-নদী শুকিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্য থেকে জানা গেছে, ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ৩.০৪ মিলিমিটার (মিমি), যা ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বছরে চার মিমি করে বেড়েছে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২১০০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্টের গড় উচ্চতা ০.৯৫ ফুট থেকে ৩.৬১ ফুট বাড়তে পারে। এ হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে বিশ্বের অনেক দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাবে। বাস্তুচ্যুত হবেন কোটি মানুষ। ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে সাতক্ষীরা জেলার নিন্ম অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের ১৯ জেলার ৭০ উপজেলার চার কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। ১৯৭৩ সালে উপকূলের আট লাখ ৩৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমি লবণাক্ত ছিল। ২০০০ সালে ১০ লাখ ২০ হাজার ৭৫০ হেক্টর; আর ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর এবং ২০২০ তা দাঁড়ায় প্রায় ৩ লাখ হেক্টর। অর্থাৎ চার দশকে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৯ ভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে ৬-২১ মিমি হারে। ফলে সময় যত গড়াচ্ছে সমুদ্রের নোনা পানি ধীরে ধীরে উজানের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০১২ সালের মার্চে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২ শতাংশ এলাকা ছিল স্বল্প লবণাক্ত। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা সর্বনি¤œ হারে বাড়লেও, ২০৫০ সালে স্বল্প লবণাক্ত এলাকার ছয় শতাংশ লবণাক্ততা বেড়ে যাবে। ভূ-গর্ভস্থ পানির লবণাক্ততাও মাত্রাভেদে উপকূল থেকে ৫০-৮০ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত বিস্তৃত।
লবণাক্ততা বাড়ায় কারণে উপকূলের প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাবার পানি সংকটে ভুগছেন। এখানে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে মাত্র দুই লিটার খাবার পানির মাধ্যমে ১৬ গ্রাম লবণ গ্রহণ করেন। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ দিনে পাঁচ গ্রাম। তার ওপর আয়রন, আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডও পাওয়া যায় এসব এলাকার পানিতে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, লবণাক্ততার প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩০ থেকে ৫০ লাখ দরিদ্র ও ২০ থেকে ৩০ লাখ অতি দরিদ্র মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। চরম আকারে হ্রাস পেয়েছে কৃষি উৎপাদন, গাছপালা নেই বললে চলে। বিলুপ্ত হয়েছে ৬০ প্রজাতির মাছ ও অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি।বর্তমানে জলবায় পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ প্রথম ১০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সেন্টিমিটার বাড়লে পানির নিচে তলিয়ে যাবে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ উপকূলীয় অঞ্চল, পরিবেশ শরণার্থী হবেন দুই কোটি মানুষ। শতকরা ২৯ শতাংশ নিচু এলাকায় বন্যার ঝুঁকি বাড়বে।
এ হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ৬৫ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমছে। এ হারে কমতে থাকলে আগামী ২০ বছর পর দেশে কৃষিজমির পরিমাণ দাঁড়াাবে ৫০ হাজার হেক্টরে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার সংকট দূর করতে উপযোগি প্রযুক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রয়াজন সুদূরপ্রসারি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: ৫/১১/২০২১ ০১৭১২৩৩৩২৯৯
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …