সব্যসাচী বিশ্বাস (অভয়নগর) যশোর:
যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার ৬নং বাঘুটিয়া ইউনিয়নের জয়খোলা গ্রামের সার্বজনীন পূজা মন্দিরে দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা ১২ নভেম্বর ২০২১ শুক্রবার শুভারম্ভ হয়েছে। গ্রামবাসীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রায় শতবর্ষী এই পূজা শুরু হয়েছে প্রতিমায় চক্ষুদান ও ঘটস্থাপনের মাধমে। ১৩ নভেম্বর শনিবার সারাদিন চলবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা। ১৪ নভেম্বর রবিবার বিজয়া দশমীতে দর্পন বিসর্জনের মাধ্যমে দেবীর বিদায়। পৃথিবীর সকল জীবের মঙ্গল কামনায় এই পূজার প্রচলন আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর পূর্বে শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এবং পরিবর্তনশীল ধরিত্রীর মঙ্গল ও শান্তি কামনায় চলছে পূজার্চনা।
শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী দুর্গা – ‘ জয় সর্বগত দুর্গে জগদ্ধাত্রী নমোহস্তুতে’! জগদ্ধাত্রী শব্দটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় – জগৎ+ধাত্রী। শব্দটির আভিধানিক অর্থ – ত্রিভুবনের ধারণকর্ত্রী বা পালিকা। ব্যাপ্ত অর্থে দেবী দুর্গা, কালীসহ অন্যান্য শক্তিদেবীগণও জগদ্ধাত্রী।
শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পূজা হিন্দুদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। দেবী জগদ্ধাত্রী-ই জগৎ সভ্যতার পালিকা শক্তি। তিনি দেবী দুর্গারই আর এক রূপ। তাই জগদ্ধাত্রীর প্রণাম মন্ত্রে তাকে “দুর্গা” বলেই স্তুতি করা হয়েছে। শাস্ত্রনির্দিষ্ট জগদ্ধাত্রী রূপের নামকরণের পশ্চাতে রয়েছে সূক্ষ্মতর ধর্মীয় দর্শন। উপনিষদে দেবী উমা হৈমবতী নামে পরিচিত। বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণ শাস্ত্রেও দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী দেবীর আরাধনা বিশেষত বঙ্গদেশে প্রচলিত। বাংলা বছরের কার্ত্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু বাঙালীর ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক দেবী কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর। তিনি ত্রৈলোক্যজননী নামে অভিহিত। সতত পরিবর্তনশীল এই বিশ্ব জগতের রক্ষন ও পোষনের জন্য অচিন্তনীয়া মহাশক্তি তিনি। এই মহাশক্তির দ্বারা বিধৃত এই পরিবর্তনশীল জগৎ। যদিও তিনি নিত্যা, শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয়া।
তিনি সিংহবাহিনী, চতুর্ভুজা, নানা আভারণ ভূষিতা, অরুন কিরনবৎ বর্ণযুক্তা। তার বাম দিকের দুহাতে থাকে শঙ্খ ও ধনু এবং ডান দিকের দুহাতে থাকে চক্র ও পঞ্চবাণ। রক্তবর্ণের বস্ত্র তার পরিধানে। তিনি সত্ত্বগুণের প্রতীক, তাই প্রথম সূর্যের ন্যায় তাঁর গায়ের রং। অর্থাৎ দেবীর গাত্রবর্নটি কমলা বা কাঁচা সোনার রং। করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দন্ডায়মান তিনি।
শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পূজার নিয়মটি একটু স্বতন্ত্র। কার্ত্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে এ দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পূজা তান্ত্রিক পূজা। দুইটি প্রথায় এই পূজা হয়ে থাকে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিনদিন দেবীর পূজা হয়ে থাকে। শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পূজাতেও দেবী দুর্গার পূজার ন্যায় বিসর্জনকৃত্য বিজয়াকৃত্য নামে পরিচিত। পুষ্পাঞ্জলী ও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্র দেবী দুর্গার পূজার অনুরূপ।
শ্রী শ্রী চণ্ডীতে প্রথম সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় যে, দেবী দুর্গার বিকল্প রূপই শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী। সেখানে বলা হয়- যুদ্ধের সময় মত্ত মহিষাসুর নানা মায়ারূপ ধারণ করে দেবীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। তারই প্রেক্ষিতে মহিষাসুর ধারণ করে হস্তরূপ। সেই হস্তীকে বধ করার উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গা চতুর্ভুজা মুর্তি ধারণ করেন।
পূর্বে ব্রাহ্মণ সমাজেই প্রচলিত ছিলো এই সত্ত্বগুণধারিণী দেবীর পূজা। পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী দেবীর একটি প্রস্তর মুর্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে মুর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে রক্ষিত আছে। শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পূজার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় মায়ামন্ত্রে বৃহস্পতি রায় মুকুটের স্মৃতিরত্নহারে (১৫-১৬শ শতক) কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রাসারে (১৬শ শতক) এবং শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামনির কৃত্যতত্ত্বার্ণবে। কৃষ্ণনগরের রাজ বাড়িতে ১৭৬৩ সালে শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পূজা প্রচলনের পর থেকে বঙ্গদেশে এই পূজা জনপ্রিয়তা পায়। ১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগর চাষা পাড়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজাগণ এই পূজা শুরু করেন। প্রথমত বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত এই পূজা চাষারা শুরু করেছিল ঘটে ও পটে। স্থানীয় গোয়ালাগণের অর্থায়নে এইরূপে পূজা চলতে থাকে। ১৭৯০ সালে গোবিন্দ ঘোষ ঘটপটের পরিবর্তে প্রতিমায় পূজার সূচনা করেন। এখানকার প্রতিমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো প্রায় ৭৫০ ভরি সোনার গহণায় দেবী প্রতিমার অলংকারসজ্জা করা হতো।