চলতি বছর উফশী, হাইব্রিড ও স্থানীয় জাত মিলিয়ে প্রায় ৪৮ লাখ ৭২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। আর সরকারের কৃষিপণ্য আবাদের পরিমাণ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সেচের জন্য তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবার বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া বোরো ধানের আবাদ ছাড়াও সবজি, তেল, ডালজাতীয় খাদ্য ও দানাদার খাদ্যশস্যও উৎপাদন করা হবে। ওসব খাদ্যপণ্য উৎপাদনেও সেচের ব্যবহার হয়। আর গোটা কৃষি খাতে সেচকাজেই জ¦ালানি তেলের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। দেশে গত অর্থবছরে প্রায় ১৬ লাখ সেচযন্ত্র পরিচালিত হয়েছে। তার মধ্যে ১২ লাখ ৪৪ হাজারটি ডিজেলে চলেছে। বাকিগুলো বিদ্যুতে পরিচালিত হয়েছে। তাছাড়া কৃষিপণ্য পরিবহনেও ডিজেলের ব্যবহার রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে চলতি রবি মৌসুমে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে। আর কৃষি উৎপাদনে বাড়তি ব্যয় নিয়ে কৃষিপণের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কিত কৃষক। কৃষক এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ডিজেলের দাম সম্প্রতি ৬৫ থেকে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে। আর জ¦ালানি তেলের ওই মূল্যবৃদ্ধি কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে আসন্ন বোরো মৌসুমেই প্রথম ধাক্কা খেতে যাচ্ছে কৃষক। আর সেজন্যই বাড়তি খরচ করে উৎপাদনের পর ন্যায্যমূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রি করা যাবে কিনা তা নিয়ে কৃষকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। ইতোমধ্যে কৃষকদের আমন ধানে বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে। কারণ জমি চাষসহ নানা কাজে খরচ বাড়তে শুরু করেছে। সূত্র জানায়, বোরো মৌসুমে দেশের মোট চালের অর্ধেকের বেশি উৎপাদন হয়। আর বোরো আবাদ অতিমাত্রায় সেচনির্ভর। ফলে ওই ধান চাষে মোট খরচের প্রায় অর্ধেকই সেচকাজে ব্যয় হয়। বোরো মৌসুমে সেচকাজে নিয়োজিত থাকে টও্য় সাড়ে ১২ লাখ ডিজেলচালিত পাম্প। কিন্তু সম্প্রতি ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষিপণ্য পরিবহন ও সেচ খরচও আনুপাতিক হারে বাড়বে। সেচ খরচ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে চুক্তির সময় পাম্পমালিক ও কৃষকদের মধ্যে বিরোধ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যানুযায়ী দেশের ১ কোটি ২৩ লাখ কৃষক ডিজেলচালিত যন্ত্রের মাধ্যমে সেচকাজ পরিচালনা করে। বাড়তি উৎপাদন খরচের কারণে ওই বিপুল পরিমাণ কৃষক উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের প্রায় ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। তবে এখনো জমিতে সেচ দেয়ার ক্ষেত্রে অগভীর নলক‚পের প্রাধান্য রয়েছে। ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র দিয়েই জমিতে পানি সরবরাহ করা হয়। মোট সেচকৃত এলাকার ৪৭ শতাংশ জমিতে সেচ প্রদানে ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুচ্চালিত যন্ত্র। বাকি ৫৩ শতাংশ জমিতে পানি দিতে ব্যবহার করা হয় ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র। অর্থাৎ ডিজেলের বাড়তি দামের বোঝা গিয়ে পড়বে অর্ধেকেরও বেশি জমিতে চাষ করা কৃষকদের ওপর। এদিকে বাংলাদেশে কৃষিজমি আবাদে মূলত কৃষি উপকরণ হিসেবে বীজ, সেচ, প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওসব উপকরণ ব্যবহারের কারণে কৃষকের খরচ হয় গড়ে ১৪ হাজার ৯০১ টাকা। আর তার প্রায় ৪৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ বা ৬ হাজার ৪৭৩ টাকা সেচকাজে ব্যয় হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্যানুযায়ী, গত বোরো সেচ মৌসুমে ৬ মাসে প্রয়োজন হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ টন ডিজেল। চলতি বছরে গত অর্থবছরের চাহিদার সমপরিমাণ ডিজেলের ব্যবহার হতে পারে। তার মধ্যে চলতি বছরের ডিসেম্বরে তেলের চাহিদা থাকবে ১ লাখ ৯৪ হাজার টন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ২ লাখ ৩৩ হাজার, ফেব্র“য়ারিতে ৪ লাখ ৬৬ হাজার, মার্চে ৫ লাখ ৫ হাজার, এপ্রিলে সাড়ে ৩ লাখ ও মে মাসে প্রায় এক লাখ টন। ওসব ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়লে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তার সঙ্গে কৃষকের পণ্য পরিবহন ও যান্ত্রিকীকরণের বাড়তি খরচও যুক্ত হবে। ফলে সেচ ও পরিবহন ব্যয়ের বাড়তি খরচ মিলিয়ে কৃষকের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যয় হতে পারে। অবশ্য ওই বাড়তি খরচ মেটাতে হলে কৃষককে বাড়তি দাম দিতে হবে। বাড়তি দাম দিলে চালের দাম বাড়বে। ফলে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জাতীয় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম জানান, বোরো ধানের আবাদ পুরোটাই সেচনির্ভর। কাজেই ডিজেলের বাড়তি দাম দেশের কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আবার কৃষকের বাড়তি উৎপাদন খরচ মেটাতে হলে অবশ্যই যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাতে দেশের খাদ্যশস্যে আমদানিনির্ভরতা বাড়তে পারে। ফলে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়া একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিতে পারে, তেমনি সামনের দিনে খাদ্য আমদানির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
Check Also
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। …