জীবনে না পাওয়ার বেদনায় হতাশ হওয়া কিংবা মানসিক চাপ অনুভব করা নতুন কিছু নয়। বিপদ-আপদ, চাপ কিংবা না পাওয়ার বেদনা যতো বেশিই হোক না কেনো; কোনো অবস্থায়ই হতাশ বা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হওয়া ঈমানদারের কাজ নয়। বরং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রাখাই সুস্থ থাকার উপায় এবং বুদ্ধিমানের কাজ। এ কথা মনে রাখা উচিত, যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে মানুষ। কুরআনুল কারিমে এমন ইঙ্গিত এসেছে অনেকবার। তখনই আল্লাহর সেই বাণীর ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ স্মরণ করাই সবার কাজ। বিপদ-আপদ, হতাশা, রোগ-শোক সবই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও- যাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫-১৫৬)
অ্যাঙ্কজাইটি বা দুশ্চিন্তা বলতে অনিশ্চয়তা কিংবা আতঙ্ক থেকে সৃষ্ট অতিরিক্ত ভয়কে বোঝায়; যা মানুষের মন ও মস্তিষ্কের মধ্যে এক ধরনের উচ্চচাপ সৃষ্টি কওে থাকে। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে কখনো কখনো আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়মিত দুশ্চিন্তার সঙ্গে যোগ হয় তীব্র মাথা ব্যথা। এছাড়াও পেশিবেদনা ও আতঙ্ক ব্যাধিসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। কখনো কখনো অযাচিত ভয় ব্যক্তির দুশ্চিন্তার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এরকম কিছু সাধারণ অনাকাক্সিক্ষত আতঙ্ক হলো পড়ে যাবার ভয়, কারো দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় কিংবা কাজে বিফল হওয়ার শঙ্কা ইত্যাদি। মুসলমান হিসেবে আমরা জানি, এ পার্থিব জীবন একটি পরীক্ষামাত্র। আমরা এ কথা বিশ্বাস করি যে- জীবনে চলার পথে কখনো কখনো আমাদেরকে চিন্তায় পড়তে হয়, ভাবতে হয়; তবে আমরা সবসময় চেষ্টা করি আমাদের এ চিন্তা যেনো আধিক্যের কারণে কখনো দুশ্চিন্তায় পরিণত না হয়। আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার সর্বোত্তম উপায় হলো আল্লাহতায়ালার কাছে সাহায্য চাওয়া, তাওবাহ-ইস্তেগফার করা, হাসিখুশি থাকা ইত্যাদি।
দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকার দোয়া করা : বিশ্বনবী সা. শিখিয়েছেন- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউযু বিকা মিনাল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া আউযু বিকা মিন দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’ অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে আপনার আশ্রয় চাই, অপারগতা ও অলসতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই আর ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকেও আপনার আশ্রয় চাই। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা : কুরআন তিলাওয়াত মানুষের অন্তরকে প্রফুল্ল করে তোলে। কেননা কুরআন তিলাওয়াত মুমিনের প্রফুল্লতার অনন্য উৎস। শুধু তাই নয়, কুরআন তিলাওয়াতে মুমিনের মনের প্রফুল্লতা ও মানসিক প্রশান্তি বাড়তে থাকে। কুরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ সব দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে থাকে মুক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এ (জ্যোতির্ময় কুরআন) দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে তাদেরকে (কুফরির) অন্ধকার থেকে বের করে (ইমানের) আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন।’ (সূরা মায়িদা : আয়াত ১৫-১৬)।
সালাতে যত্নবান হওয়া : মানুষের যে কোনো বিপদ-মুসিবত, পেরেশানির সময় নামাজের মাধ্যমেই প্রকৃ প্রশান্তি লাভ কর যায়। কেননা নামাজের মাধ্যমেই বান্দা মহান আল্লাহর সাহায্য লাভ করে থাকেন। তাই মানসিক প্রশান্তি লাভে নামাজের ব্যাপারে যতœবান হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘তোমরা নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে আমার সাহায্য প্রার্থনা কর। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সেসব বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।’ (সূরা বাকারা : আয়াত ৪৫)। রাসুল সা. কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজ আদায় করতেন।’ (সুনানে আবু দাউদ)। সাহাবায়ে কেরামও এ আমলে অভ্যস্ত ছিলেন। ছোট থেকে ছোট কোনো বিষয়ের জন্যও তারা নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।
তাওবা ইসতেগফার করা : মানসিক চাপ সামলাতে বেশি বেশি ইসতেগফারের বিকল্প নেই। যেসব কারণে মানুষ চাপে পড়ে, তন্মধ্যে অন্যায়-অপরাধ বেশি করা, স্বল্প অর্থে তুষ্ট থাকা, সন্তানসন্ততি না থাকা, জীবিকার অপ্রতুলতা ইত্যাদি। এ সবের সমাধানে কুরআনের নির্দেশ হলো তাওবা-ইসতেগফার করা। এ ইসতেগফারেই মানুষ উল্লিখিত সমস্যা থেকে সামাধন খুঁজে পায় বলে ঘোষণা করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। পবিত্র কুরআনে এসেছে-‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর অজ¯্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্তুতি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’ (সূরা নুহ : আয়াত ১০-১২)।
আল্লাহর প্রতি আস্থা ও ভরসা রাখা : মানসিক অশান্তি থেকে মুক্ত থাকতে মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলের (ভরসা) বিকল্প নেই। কেননা তিনিই বলেছেন, ‘যে মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল বা ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা তালাক : আয়াত ৩)। সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করতে জানে তার জন্য কোনো চিন্তা নেই। হাদিসে এসেছে-রাসুল সা. বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, আমি সেরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে।’ (সহীহ বুখারি)।
বিলাল মাহিনী
গবেষক : আল ফিকহ ওয়াল ফারায়েজ (মুসলিম আইন ও উত্তরাধিকার বিভাগ)
প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।