পরিবেশ বিপর্যয়ে সাতক্ষীরায় আমনের আবাদ নেমেছে অর্ধেকে

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়ে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে আমন ধানের আবাদ ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। গত সাত বছরে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে আমনের আবাদ অর্ধেকে নেমে এসেছে। পরিবেশ বিপর্যয়, জমিতে লবণক্ষতা বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ঘের করার কারণে জেলায় ধানের আবাদ হ্রাস পাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সময় উপযোগী বার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে আগামি ১০ বছরে মধ্যে সাতক্ষীরায় আমনের উৎপাদন শূন্যের কোটায় নামার শঙ্কা রয়েছে। প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে বেশি ধান উৎপাদন করতে না পারলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না । ফলে চরম খাদ্য সংকটে পড়তে পারে জেলার কয়েক লক্ষ নিন্ম আয়ের মানুষ।
সুত্রানুযায়ী বাংলাদেশ পৃথিবীর ধান উৎপাদনকারী দেশ গুলোর মধ্যে চতুর্থ হলেও এখানকার হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৪.২ টন। চীন, জাপান ও কোরিয়ায় এ ফলন হেক্টর প্রতি ৬-৬.৫ টন। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে ধানের ফলন বাড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই বলে জানান বিশেজ্ঞরা। চাষিরা জানান, সনাতন জাতের ধান এবং মান্ধাতার আমলের আবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। এজন্য প্রযেয়াজন উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন ।
কৃষকরা জানান, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের জন্য যেখানে ছিলো যথাযোগ্য তাপমাত্রা, ছিলো ছয়টি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ঋতু, সেখানে দিনে দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতু হারিয়ে যেতে বসেছে এবং তার সাথে সাথে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আসছে। ফলে অনিয়মিত, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত; সেচের পানির অপর্যাপ্ততা; উপকূলীয় অঞ্চলে বর্ষা মৌসুম ছাড়াও বিভিন্ন সময়় উপকূলীয় বন্যা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিতে লবণাক্ত পানিতে জমি ডুবে যাওয়া, এবং শুষ্ক মৌসুমে মাটির নিচের লবণাক্ত পানি উপরের দিকে বা পাশের দিকে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার কৃষির ভবিষ্যৎ চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার কারণে প্রধান অর্থকরি ফসল হলো আমন ধানে চাষ চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে । ফলে আমনের আবাদ কমিয়ে মাছ চাষের দিকে ধাবিত হচ্ছে জেলার চাষিরা। এতে কর্মসংস্থান কমে বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহমান কাল থেকে এ ধানেই কৃষক তার পরিবারের ভরণপোষণ, পিঠাপুলি, আতিথেয়তাসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে থাকতো। কিন্তু বর্তমানে তা যেন শুধু স্মৃতি হতে চলেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলায় ৬০ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১৬ হাজার ৪ শত ৮০ হেক্টর, কলারোয়া উপজেলায় ১১ হাজার ৬ শত হেক্টর, তালা উপজেলায় ৪ হাজার ৭ শত হেক্টর, দেবহাটা উপজেলায় ৩ হাজার৮ ২ শত হেক্টর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ১১ হাজার ২৫০ হেক্টর, আশাশুনি উপজেলায় ৩ হাজার ৫২ শত ২০ হেক্টর ও শ্যামনগর উপজেলায়৮ হাজার ৭ শত ৫০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হচ্ছে। যা বিগত বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ কম।
২০১৭- ১৮ মৌসুমে আমনের আবাদ হয় জেলায় ৮৩ হাজার ৭ শত ৬৫ হেক্টর জমিতে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে জেলায় ৮৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়। ২০১৫-১৬ মৌসুমে জেলায় আমনের আবাদ হয় ৯৪ হাজার ২০০ হেক্টর। কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানায় ২০১৭-১৮ মৌসুমে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে সারাদেশে আমন আবাদ এরিয়া ২% বৃদ্ধি পায়। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রতি বছর আমনের উৎপাদন বাড়ছে। যেখানে সাতক্ষীরা জেলাতে হ্রাস পাচ্ছে।
খলিষখালির মঙ্গলান্দকাটী গ্রামের জাহাতাব শেখের ছেলে সাবেক ব্যাংকার আব্দুস সামাদ জানান, তার ১০ বিঘা জমিতে আগে আমনের চাষ হত। বর্তমানে তিনি আমন আবাদ করে না। তিনি জানালেন, আগে যে খাল দিয়ে পানি সরতো এখন সে সব খাল আবদ্ধ খালে পরিণত হয়েছে। এসব খাল সমূহে বাঁধ দিয়ে প্রভাব শালিরা মাছ চাষ করছে। ফলে পানি সরানোর কোন ব্যবস্থা না থাকায় আমন উৎপাদন করা যায় না।
সাতক্ষীরার পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বাবুল আক্তার বলেন, তাদের প্রচেষ্টায় আবাদ কমলেও আমন ধানের উৎপাদন বেড়েছে। এবারের মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলার ১৫০ জন চাষি বিনা ১৭ জাতের ধান চাষ করেছেন দেড় হাজার একর জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার কৃষকরা এই জাতের ধানের ভালো ফলন পাচ্ছেন।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, জেলায় আমনের আবাদ কিছুটা কমছে। তবে উৎপাদনের পরিমান বেশি হচ্ছে। এছাড়া নানা কারণে জেলাতে আমন চাষের পরিবর্তে চাষীরা বোরো ধান সহ ঘের করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে। আমন উৎপাদন বৃদ্ধি করতে কৃষি কর্মকর্তারা নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

Check Also

টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ট্রিপল মার্ডার সা’দ অনুসারীদের মুখপাত্র মোয়াজকে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে প্রেরণ

মূল নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াসিফুল ইসলাম ছেলে ওসামা মেয়ে জামাতা আ’লীগ নেতা এরতেজা স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুরঃ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।