জহিরুল ইসলাম শাহিন
পৃথিবীতে যতগুলি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আছে তার মধ্যে অন্যতম সেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধিকারী বাংলাদেশের সুন্দরবন। যাহা একেবারে দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল ঘেষা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত এবং পশ্চিম অঞ্চলটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। এক কথায় বলা চলে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দক্ষিণ বঙ্গের জন জঙ্গলাকীর্ণ সু বিস্তৃত গাঙ্গেয় নি¤œভূমি অঞ্চলের সাধারণ নাম ‘সুন্দরবন’।
খ্রিস্ট ষষ্ট শতকের আগে গঙ্গার মূল প্রবাহ থেকে ভৈরব ও পদ্মা নদী প্রবাহিত হওয়ার পর সুন্দরবন অঞ্চলে ব-দ্বীপের সৃষ্টি হতে থাকে। কোন কোন গবেষকদের ধারণা পঞ্চম শতক থেকে তের শতকের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে এ অঞ্চলে আস্তে আস্তে জেগে উঠতে থাকে কখনো পলির দ্বীপ হিসেবে, কখনো গভীর অরন্য প্রাকৃতিক ভাবে সংকুল অনা বাসযোগ্য জলাভূমি হিসেবে। যা দেখতে চারদিক থেকে বিষ্ময়কর ভিতরে ভিতরে বিশাল জলাকার এবং তার সমস্ত ফাকা অঞ্চল জুড়ে বিশাল জঙ্গল, দেখতে অত্যন্ত সুন্দর, চোখ জুড়িয়ে আসে।
চোখে না দেখলে কিছুই জানা যাবে না বা বোঝা যাবে না। সৃষ্টিকর্তার রহস্যটা আসলে কি? আমার ব্যক্তিগত ধারণা- পৃথিবীতে যতগুলি সেরা সৃষ্টি সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট যার নাম আজকে বিশ্বে বিখ্যাত এবং বাঙালীর গর্ব ও অহংকার এবং বাংলার গর্ভে জন্ম বাংলাদেশের ‘সুন্দরবন’। সুন্দরবনের পূর্বে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা ও বরগুনা জেলার পাথরঘাটা থানা, মধ্য অঞ্চলের বাঘেরহাট জেলার শরণখোলা, মোড়লগঞ্জ উপজেলা ও মংলা থানা এবং খুলনা জেলার পাইকগাছা কয়রা ও দাকোপ উপজেলা এবং বনটির উত্তরে প্রিয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা ও কলকাতার দক্ষিণে ডায়মন্ড হারবর ও হলদিয়া বন্দর পর্যন্ত এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
প্রাচীনকালে প্রায় যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলা পর্যন্ত সমৃদ্ধ জনপদ সুন্দরবন স্থান হিসেবে যতই পূরানো বা প্রাচীন হোক এই বনের বর্তমান নামটি তত প্রাচীন নয়। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনের পরিচিতি প্রচ্ছন্ন রয়েছে ইতিহাস সমৃদ্ধ গঙ্গা হৃদয়, গঙ্গে সমতট, কালিকাবন প্রভৃতি স্থান নামের অন্তরালে। মধ্যযুগের মুসলমান ঐতিহাসিকগন এই নি¤œভূমি বনাঞ্চলকে ‘ভাটি’ নামে উল্লেখ করেছেন।
পাঠান যুগের শেষে এখানে বার ভুইঞার আধিপত্য অতিশয় বৃদ্ধি পায় বলে এর নাম দাঁড়ায় ‘বার ভাটি বাঙ্গালা’ এর পরপরই বনটির অতিমাত্রায় সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারনে আস্তে আস্তে করে নাম দাড়ায় ‘সুন্দরবন’। এই সুখশ্রাব্য নামটি অতি দ্রুত প্রচলিত হতে থাকলো। তাছাড়া সুন্দরবনের উৎপত্তি বিষয়ে নানা ব্যাখ্যা ও প্রচলিত আছে। সুন্দরবনের সর্বত্রই জুড়ে প্রচুর সুন্দরী বৃক্ষ জন্মে এবং সুন্দরী বৃক্ষ বা গাছ অন্যান্য বৃক্ষ থেকে অনেকটা জন সাধারণের কাছে জনপ্রিয় বা পছন্দের এবং অধিকতর পরিচিত।
সুতরাং সুন্দরী বৃক্ষ হতেই বনের নামকরণ হয়েছে সুন্দরবন। এরূপ অনুমান মূলক কথা বা উক্তি যথেষ্ট যুক্তিসিদ্ধ এবং নামের এই ব্যাখ্যা সর্বশ্রেণীর জনগনের কাছে গ্রাহ্য। একথাও সত্য ইংরেজ শাসন আমলে এবং ইহার অনেক পূর্বে ও বিদেশী পর্যটকেরা বা দর্শণার্থীরা সুন্দর বনের নানা প্রকার বৃক্ষাদি দর্শনে উহাকে ‘জঙ্গল অব সুন্দরী ট্রীস’ নামে আখ্যায়িত করতেন। এই ইংরেজী শব্দটির অর্থ নানা প্রকার এবং এই সুন্দরী শব্দ থেকে ধীরে ধীরে বনাঞ্চলটির নাম হয় সুন্দরবন।
আবার কোন কোন বিশেষজ্ঞদের মতে সমুদ্রের বক্ষে বা তীরে এই জঙ্গলটি অবস্থিত এবং সর্বত্র সমুদ্রের জোয়ারের জলে সিক্ত বলে এর নাম সমুদ্র এবং এই সমুদ্রবন শব্দের অপভ্রংশই সুন্দরবন। আবার কেহ কেহ মনে করেন খুলনার পূর্ব অংশ নিয়ে ও বরিশালের বাকেরগঞ্জের দক্ষিণ সীমা নিয়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য গঠন করা হয়েছিল এবং চন্দ্রদ্বীপের যে বন বিভাগ ছিল তাকে চন্দ্রবন বলা হতো। এই চন্দ্রবন থেকে সুন্দরবন নামের উৎপত্তি হয়েছে এটাও বলা হয়ে থাকে।
যাইহোক সুন্দরবনকে আমরা যেভাবেই সংগায়িত করিনা কেন দক্ষিণ বংলার ঐতিহ্যবাহী এবং অহংকার ও গর্ব করার মত এক নয়নাভীরাম দৃশ্য সুন্দরবন। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে, পূর্ব অঞ্চলে এবং একবারে দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলে বিশাল বিশাল পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে দর্শনার্থীরা অত্যন্ত মুগ্ধ এবং সন্তুষ্ট প্রকাশ করে এই ভেবে যে, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র দেশ হলেও এবং এ দেশের চারদিকের যে প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং কিছু ঐতিহাসিক স্থান আছে যা পৃথিবীতে অনেক অংশে নেই এবং বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো ‘বন’ এটাতেই আমরা গর্বিত এবং এ দেশ আমাদের অহংকার।
এবং আমরা সাতক্ষীরা বাসী বেশী গর্বিত যে সুন্দরবন আমাদের জেলায় শ্যামনগরে অবস্থিত এবং আমরা আরও বেশী গর্বিত যে সুন্দরবনের চর সমুহের সবুজ বৃক্ষরাজি, বিভিন্ন প্রজাতির, মৎস্য, পশুপাখি, সাপ, কুমীর, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুন্দরবনের মধু, বিভিন্ন বন্য জন্তুর দলে দলে অবাধ বিচরণ, বিশেষ করে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণের বনের সীমানা প্রাচীরে অবাধ ছোটাছুটি, বানরের নানা প্রকার মুখভঙ্গী আঁকা বাঁকা নদনদীর জল, দুবলার চর , হীরন পয়েন্ট সহ সাগর ঘেষা সকল ধরনের নদীর জল স্্েরাত ও ধূ ধূ জল রাশি এবং দক্ষিণ সীমায় বঙ্গোপসাগরের উপকুলের সুর্যোদয় এবং পশ্চিম সীমায় সুর্যাস্তের দৃশ্য প্রভৃতি সত্যিই ম্যান গ্রোভ নামের ফরেস্ট সুন্দরবন কে সুন্দর করে তুলেছে।
আমরা এখন সুন্দর বন সম্পর্কে আর একটু জানার চেষ্টা করি। সুন্দরবনের মোট আয়তন ৫ লাখ সাতাত্তর হাজার হেক্টর যার চার লাখ এক হাজার ছয়শত হেক্টর বনভূমি এবং একলাখ পঁচাত্তর হাজার ছয়শত হেক্টর খান ও নদী। কিলোমিটার হিসেবে এর আয়তন দাঁড়ায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আমাদের সুন্দরবনের সাথে সেতুর বন্ধন সৃষ্টি করেছে মেঘনা, তেঁতুলিয়া কাফলা, আগুনমুখী, বামনাবাদ, ভোলা, সন্ধ্যা, শিবসা, মালঞ্চ, বালেশ্বর, হাড়িয়াভাঙ্গা, রায়মঙ্গল ইত্যাদি নদনদী।
সুন্দরবন মূলত মেঘনা ও পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী ব-দ্বীপাঞ্চলে অবস্থিত। নদ নদী ছাড়া ও অসংখ্য খাল, নালা ও সামুদ্রিক খাড়ী দ্বারা বিধৌত সুন্দরবন। জোয়ারের সময় অধিকাংশ এলাকা ভেসে যায় জলে- যুগের হাওয়া বদলের সাথে সাথে নদ নদী গুলোর গতি পরিবর্তিত হচ্ছে অহরহ। সেই সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে বনভূমি এলাকা। বনের শ্রেণী বিন্যাসের দিক থেকে সুন্দরবনকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যেমন স্বাদু পানি যুক্ত বনাঞ্চল, মৃদু লবনাক্ত বনাঞ্চল ও তীব্র লবনাক্ত বনাঞ্চল।
সুন্দরবনের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ঠ্য হলো এরা বেশীর ভাগই লোনা মাটি ও জলজ শ্রেণীর। সুন্দরবনে মোট ৩৩০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান প্রধান গাছগুলো হচ্ছে সুন্দরী, পশুর, কেওড়া, গেওয়া, বাইন, গরান, গর্জন, কাকড়া, ওড়া, বেত, ঝাউগাছ, গোল, হোগলা, সিংড়া, খলসী, বুনো, লেবুগাছ, বনচন্দন, বনজাম, গাব, হিজল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আমাদের ঐতিহ্য, বাংলাদেশের ঐতিহ্য, আপামোর জন সাধারাণের ঐতিহ্য সুন্দর বনের অন্যতম ও বিশ্বের অন্যতম বিশ্ব বিখ্যাত হিং¯্র রয়েল বেঙ্গল টাইগারে ঘেরা ঘন বন আমাদের সুন্দরবন।
এছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে বানর, বন্য শুকর, বন বিড়াল, সজারু, শিয়াল, সাপ, গুইসাপ, বেজীসহ প্রায় ৪২ প্রজাতির বন্য প্রাণী। জল জন্তুর মধ্যে কুমীর, হাঙ্গর, শোষ, সর্প কেউটে, অজগর, গোখরা, শংখবাজ, দুধরাজ, পীতরাজসহ ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ সুন্দরবনে বাস করে। সর্বদিক দিয়ে সুন্দরবনকে মহান আল্লাহ তায়লা একটি সয়ংসম্পূর্ণ পূর্ণাঙ্গ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট একটি বনাঞ্চলে পরিণত করেছেন।
সুতরাং অতি সহজেই আমরা বলতে পারি সুন্দরবন এমন একটি বন যা অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ও ঐশ্বর্যে ভরপুর। এই বন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখন আমাদের সকলের। বিশেষ করে সাতক্ষীরা খুলনা ও বাগেরহাট এলাকার জনগনের। উক্ত এলাকার জনগনকে সোচ্চার ও সচেতন হতে হবে, সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঐতিহ্য জলজ ও বনজ উদ্ভিদ এবং বন্য জীবজন্তু রক্ষণাবেক্ষণের যদি সম্ভব না হয় একদিন আমাদের মাঝখানে এই ঐতিহ্যবাহী ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বিলীন হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সুন্দরবনের খুব নিকটে এবং ভিতরে বিভিন্ন পেশার লোক অস্থায়ীভাবে বসবাস করে। যাদের সাথে সমগ্র সুন্দরবনের যোগসূত্র ঘনিষ্ট ভাবে গ্রথিত। তাদের মধ্যে বাওয়ালী, মৌয়াল, মালঙ্গী, কাগচি, মৎস্যজীবী এবং জোঙরাখুটা ব্যতিত কিছু লোক সর্বদা ভ্রাম্যমান অবস্থায় সুন্দরবনের ভিতরে সাময়িক ভাবে ব্যবসায়িক কারনে এবং ভ্রমন উপলক্ষে অবস্থান করে। আমরা যদি কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে বিবেচনা করি দেখা যায় কাঠ কাটা, গোলাপাতা এবং মধু সংগ্রহ করা বা আহরন করা, মাছ ধরা এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজে এ সুন্দরবন দৈনিক হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করে যাচ্ছে।
জল ও জঙ্গল কেন্দ্রিক এই জীবিকা কর্মে সংগ্রাম মুখতার সংগে মিশে আছে মৃত্যু ভয়। একদিকে জলে কুমির, অন্যদিকে ডাঙ্গায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে জেলেরা, মৌয়ালেরা এবং বাওয়ালীরা দক্ষিণে গভীর অরণ্যের দিকে জীবনে মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে কোন রকম জীবন জীবিকার জন্যে মুখে দুমুঠো অন্ন যোগানোর জন্য দুর্দান্ত সাহস নিয়ে নৌকা বা ট্রলার করে দলবদ্ধ ভাবে তাদের অভিযান চালাচ্ছে। মরণপন লড়াই করে ও গভীর জঙ্গলের মধ্যে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার মত কোন অবস্থা তারা তৈরী করতে পারছে না। তাদের আর্থিক অবস্থা আসলে অত্যন্ত শোচনীয়।
তারা যাতে কিছুটা নিরাপত্তার ভিতর দিয়ে কাজ করতে পারে এবং জীবন চলার পথ সচল রাখতে পারে তার জন্য সরকারকে একটা পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে বলে আমি মনে করি। এই সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের কারনে সুন্দরবন অনেকটা বনদস্যু ও জলদস্যুদের হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাচ্ছে। কোস্ট গার্ড এবং যে সমস্ত নৌবাহিনীর সদস্যরা ভয়কে জয় করে গভীর নদীর ভিতরে থেকে এবং সাগরের ভিতরে থেকে সুন্দর বনকে রক্ষা করার জন্য পবিত্র দায়িত্ব পালন করছেন তাদের প্রতি আমরা চির কৃতজ্ঞ।
লেখক: জহিরুল ইসলাম (শাহিন), সহঃ অধ্যাপক ইংরেজী, বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ, কলারোয়া, সাতক্ষীরা।