বিগত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা উচ্চ শিক্ষায় বিশেষতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুটেক্স, বুয়েট, মেডিকেল ও গুচ্ছসহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় (খ ও ঘ ইউনিটে) মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও সাফল্য ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শ্রেণি হিসেবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাফল্যে আমরা বিচলিত না হয়ে বরং তাদের মূলধারায় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানানো কর্তব্য বলে মনে করাই শ্রেয়। তবে তাদের সাফল্যে অনেক বুদ্ধিজীবী কাম-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রীতিমতো অপমানিত বোধ করছেন এবং তারা প্রকাশ্যেই বলার চেষ্টা করছেন যে, ‘এভাবে যদি চলতে থাকে তবে দেশের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে।’
দেশের আলিয়া মাদরাসা থেকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় সুযোগ করে নেওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতার আগেও অনেকেই এসেছেন; কৃতীও হয়েছেন কেউ কেউ। তেমনি আসছে স্বাধীনতার পরও। সফলও হচ্ছেন অনেকে। সরকারি কর্মকমিশনের বাইরে ব্যাংক, বীমা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানেও মাদরাসা ছাত্রদের বিনা ঘুষে নিয়োগ লাভের হার এবং পরবর্তী কর্মজীবনে বিনা ঘুষে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তারা যে বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছেন তাতে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধির কারখানায় মহামারীর আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে বলে মনে করছেন অনেকে। মনে রাখতে হবে, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সাধারণ ধারায় আসেন এবং টিকে থাকেন প্রতিযোগিতা করেই। মূলধারাতেও তাদের অনেক লড়াই করতে হয়েছে। তেমনি এবার একজন এলেন খ ইউনিটে প্রথম স্থান অধিকার করে। জানা গেছে, সে বৃত্তি পেয়েছিল পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে। এবার দাখিল (এসএসসি) ও আলিমে (এইচএসসি) ভালো ফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে; প্রথম হয়েছে। ঘ ইউনিটেও প্রথম হয়েছে মাদরাসার একজন ছাত্র। গুচ্ছতেও। তাদের এ ফলাফল খুব স্বাভাবিক বলে ধরা চলে। এতে কেউ কেউ বিচলিত হচ্ছেন দেখে হতাশ হতে হয়। তারা ভর্তি পরীক্ষার স্বাভাবিক নিয়মকানুন অনুসরণ করে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। আমাদের তো তাদের মূলধারায় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানানোই উচিত।
গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, ঢাবি’র অনেকগুলো ইউনিটেই শতকরা প্রায় ৯০ জন ভর্তি পরীক্ষার্থী পাস নম্বরই পায়নি। এটা খুবই দুঃখজনক এবং আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান দৈন্যের স্মারক। আবার পরীক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অনেকে তুলনামূলক ভালো ফল করেছে। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে বিশেষ করে, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভালো ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নানামুখী আলোচনা চলছে। মাদরাসার দাখিল ও আলিম সরকার স্বীকৃত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। বর্তমানে দেশের তিনজন ছাত্রের একজন মাদরাসার এবং সংখ্যাটি দেড় কোটির কাছাকাছি। এখন দেশে মাদরাসার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আলিয়া মাদরাসাগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা বেসরকারি স্কুল-কলেজের মতো সরকারের এমপিও সুবিধার আওতায় বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। স্বাধীনতার পর প্রথম শিক্ষা কমিশনই মাদরাসাশিক্ষা বহাল রাখার পক্ষে মত দেয়। আর বর্তমান সরকার কওমি মাদরাসাগুলোর ডিগ্রির সমতাকরণ করে তাদেরও মূলধারায় নিয়ে আসার চেষ্টায় রত। ধরে নেয়া যায়, দেশের বাস্তবতার নিরিখেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ সত্য যে কওমি মাদরাসা পরিচালনায় সরকারের কোনো নিয়মনীতি বা নিয়ন্ত্রণ নেই। তা সত্ত্বেও এগুলো চলছে এবং ক্রমবিকাশ ঘটছে।
আমাদের দেশের মাদরাসা পড়–য়া মেধাবীরা সাধারণত সমাজের নিম্নবিত্ত অথবা দরিদ্র পরিবারগুলো থেকে উঠে আসে। তাদের পারিবারিক চাহিদা, পারিবারিক বন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতি-নৈতিকতার কঠোরতা, ধর্মাচার এবং পাঠ্যক্রমের গুণগত মান তাদের ভালো মানুষ হিসেবে বড় হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়। অপরদিকে, পৃথিবীর প্রাচীনতম শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে মাদরাসাগুলোতে যে শিক্ষার পরিবেশ থাকে তা অন্য কোনো দেশের কোনো পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই আজ অবধি চালু করতে পারেনি। আজকে আধুনিক শিক্ষার নামে আমরা যা কিছু পাঠ করছি তার বয়স বড়জোর ৩’শ বছর। এই ৩’শ বছরে বিভিন্ন দেশে অন্তত ৫০-৬০ বার শিক্ষাব্যবস্থায় পরস্পরবিরোধী পরিবর্তন করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশের জেএসসি-জেডিসি, পিইসি, এসএসসি-দাখিল, এইচএসসি-আলিম, বিএ, এমএ ইত্যাদি ডিগ্রির কথা যদি বলি তাহলে দেখা যাবে, গত ১’শ বছরে বহুবার এই পরীক্ষাগুলোর নাম এবং সিলেবাস পরিবর্তন হয়েছে। ফলে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র-শিক্ষক, পিতা-পুত্র অথবা মা-কন্যার মধ্যে চিন্তা চেতনা তথা শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অমিল-অশ্রদ্ধা, ভিন্নমত ও অস্থিরতা রীতিমতো দিনকে দিন দানব আকার ধারণ করেছে।
অন্যদিকে, যদি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকাই তবে দেখব যে, গত ১৪’শ বছর ধরে এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাঠামো একই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং যুগ যুগান্তরের আইন-বিজ্ঞান, ভুগোল, অঙ্ক, জ্যামিতি বা শিল্পসাহিত্যের নিত্যনতুন ধারা আদি কাঠামোর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ফলে এই শিক্ষার ভিত্তিমূলে কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে অবকাঠামোকে যুগোপযোগী এবং আধুনিক বানানো হয়েছে।
দেখুন, ইংরেজি সাহিত্য বা বাংলা সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, অঙ্কশাস্ত্র, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে যাদের রচনা দিয়ে পাঠ্যক্রম সাজানো হয় তাদের সাথে যদি আরবি ও ফারসি ভাষার পাঠ্যক্রমের রচয়িতাদের বয়স, যোগ্যতা, মেধা, জনপ্রিয়তা, জ্ঞানের গভীরতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যের পভাব প্রতিশ্রুতির তুলনা করা হয় তাহলে কী ফলাফল আসবে তা অনুধাবন করার জন্য সাধারণ যুক্তি ও জ্ঞানই যথেষ্ট। যারা বার্ট্রান্ড রাসেল, সক্রেটিস, মিশেল ফুকো প্রমুখের দর্শনতত্ত্ব পড়ে পৃথিবীর সব কিছু বুঝে ফেলেছেন বলে মনে করেন, তারা ইবনে খালদুন, জাবের ইবনে হাইয়ান, আলরাজি, ইবনে সিনা, আল্লামা ইকবাল প্রমুখ রচিত দর্শন ও অন্যান্য শাস্ত্রগুলোর কয়েকটি পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করুন। এরপর বুকে হাত দিয়ে বলুন, আপনার পক্ষে অনন্ত পৃথিবীর কতটুকু জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়েছে!
বিবেচনায় নেয়া দরকার যে, আমাদের মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান সাধারণ লাইনের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে পেছনে। তবুও তাদের জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ দেওয়ার দাবি কেউ করে না। তই তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সাধারণ বিচারে মাদরাসা ছাত্রদের লেখাপড়ার মান তুলনামূলকভাবে কিছুটা দুর্বল। আর এ দুর্বলতাকে অতিক্রম করে কেউ যদি ভালো করে, তাকে উৎসাহ দেওয়া উচিত। তা না করে তাদের প্রতি বৈরী আচরণ সমর্থনযোগ্য হবে না। শিক্ষার্থীদের এক-তৃতীয়াংশ যদি মাদরাসার হয়ে থাকে, তবে সরকারের উচিত হবে তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ দরকার।
বিলাল মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।