বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী’র মাসে সুশাসন ও গণতন্ত্রের প্রত্যাশা – বিলাল মাহিনী

আজ থেকে শুরু হচ্ছে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর মাস, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাক্ষর বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী’র মাস অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালিত হবে।
 বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয় এ মাসে। ডিজিটালাইজেশ ও উন্নয়নে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন হলেও পূর্ণ গনতন্ত্রের বিকাশ, সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থায়ী হলে বাংলাদেশ সত্যিকারের সোনার দেশে পরিণত হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা, অর্জন করে নিজস্ব ভূ-খন্ড। আমরা পাই সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিলো, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এ দিনে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এবার আমরা উদযাপন করছি বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী হলো ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরপূর্তি পালনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃৃক ঘোষিত একটি বার্ষিক পরিকল্পনা। সরকার ২৬ মার্চ ২০২১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ’২১ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ২০০৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করে, যেখানে ’২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল, ডিজিটাল ও আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
লাল সবুজের পতাকা, একটি স্বধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র যাদের নেতৃত্ব ও অবদানে আমরা পেয়েছি তাদের মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান সর্বাগ্রে। বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাওয়া মানুষটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যাকে পারিবারিকভাবে আদর করে ডাকা হতো খোকা, আপামর জনতার দেয়া নাম ‘বঙ্গবন্ধু’, কেউ বলে স্বাধীনতার মহানায়ক, কেউ বলে রাজনীতির কবি, বাংলাদেশের সংবিধান তাকে দিয়েছে জাতির পিতার স্বীকৃতি।
 বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে জাতির পিতাসহ বাংলাদেশ বিনির্মানে আত্মত্যাগকারী ও অবদান রাখা সকলের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে, প্রতিটি ঘটনার মূখ্য চরিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন; ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সাধারণ নির্বাচন; ১৯৬২ সালে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন; ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন; ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা; ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথান; ১৯৭০ সালের নির্বাচন; ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ; ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা; ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ পুরোটাই বঙ্গবন্ধুময়। পাশাপাশি মওলানা ভাসানী, জাতীয় চার নেতা, আ স ম রব, শাহজাহান সিরাজ, ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ অসংখ্য বীর যোদ্ধার অসামান্য অবদান রয়েছে।
আজ বিজায়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি এবং উন্নয়নের এ ধারা অব্যহত থাকলে আগামিতে আমরা আধুনিক এবং উন্নত দেশে পরিণত হব, ইন শা আল্লাহ।  বাংলাদেশে অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, তন্মোধ্যে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল,  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, সারা দেশজুড়ে রাস্তাঘাট কালভার্ট নির্মাণ, দেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ নিজস্ব অর্থায়নে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচক ও জরিপে এগিয়েছে বাংলাদেশ।
আজ বাংলাদেশ ও স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ৫০ বছর পূর্তি হলো। তাই পেছন ফিরে তাকালে আমাদের স্বস্তির অনেক কারণ পাওয়া যায়। অন্তত এ ৫০ বছরে আমাদের অর্জন খুব একটা কম নয়। হয়তো অর্জন আরও বেশি হতে পারত; তবে যা হয়েছে তা খুব সামান্যও নয়, এককথায় অসামান্য। বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে সম্মানজনক দেশ ও রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আমাদের আরও অনেক বিষয়ে আরও গভীর মনোযোগ দিতে হবে। যেমন, সুশাসন ও গণতন্ত্র। এজন্য রাজনৈতিক সহাবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। ৫০ বছরে আমাদের যে উন্নয়ন, তার মধ্যে ‘সুশাসন’-এর অভাব প্রকট। সুশাসন না থাকা সত্ত্বেও যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু উচ্চ প্রবৃদ্ধি সুশাসনের বিকল্প নয়। প্রবৃদ্ধি ও সুশাসন পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। এ যোগসূত্র দুটোকেই বেগবান ও টেকসই করবে, ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে এখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।
পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক প্লান্ট, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, উড়ালসেতু প্রভৃতি বড় বড় কাঠামোর কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার বজায় থাকলেও শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুশাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সূচকগুলোতে আমাদের অবস্থান সম্মানজনক বলা যায় না। ২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। সুবর্ণজয়ন্তী’র এই আনন্দঘন ক্ষণে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন ও গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রা শুরু হোক, এটিই হোক সবার আন্তরিক অভিপ্রায়।
বিলাল মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর

Check Also

সাতক্ষীরায় বিজিবির অভিযানে দশ লাখ টাকার মালামাল আটক

সাতক্ষীরা ও কলারোয়া সীমান্তে চোরাচালান বিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে মাদকদ্রব্যসহ প্রায় দশ লক্ষ টাকার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।