আমাদের স্বাধীনতা একদিনে বা একটি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসেনি। বাঙালি হিসেবে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তি উদযাপন করলেও বিজয়ের চূড়ান্ত স্বাদ পেতে আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ শত শত বছর সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল আজকের বিজয়। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা বৃটিশ ও পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে মুক্তি পেলেও স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ তথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সুশাসন ও পূর্ণ গণতন্ত্র এবং জনগণের সরকার পেয়েছি কী? বাংলার মানুষ মুক্ত মনে কথা বলা ও লেখার স্বাধীনতা কতটুকু পেয়েছে? প্রশ্ন থেকেই যায়! তবে উন্নয়ন ও অর্জন যে বহু তা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলা যায়।
তবে মজার ব্যাপার হলো, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সমাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলেও সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হলো- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। রচিত হলো সংবিধান। সুরক্ষা করা হলো মানুষের অধিকার। কিন্তু দেখা গেলো, তৎকালীন শাসক ও সেনা শাসকেরা গণতন্ত্রিক ভাবধারা উপেক্ষা করে জনগণের মতামত গ্রহণ না করে নিজের ইচ্ছায় দেশ চালানো শুরু করলেন। তারা বৃটিশ, পাকিস্তানের ভাবধারায় দেশকে শাসন করতে শুরু করলেন। জনগণের প্রতিনিধির কোন মূল্য থাকল না। গণতন্ত্রকে পদদলিত করে একদলীয় শাসন শুরু হল। বাংলার মানুষ আন্দোলন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও থেমে থাকেনি। ১৯৯০ সালে এরশাদের একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার জনতা সংগ্রাম করে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সকল ধর্মের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলো।
আজকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তি পালনেও আমরা ভুলে গেছি বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটির গোড়াপত্তনে যাদের অবদান ছিলো, ত্যাগ ছিলো সীমাহীন, তাদেরকেও। আমরা ভুলে গেছি এই স্বাধীন ভূখন্ড প্রতিষ্ঠার জন্য মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম বসু, শের-ই- বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজ উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী ও সেক্টর কমা-ারদের কথা। ভুলে গেছি সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ, আ.স.ম. রব, শাহজাহান সিরাজ, জীবন্ত কিংবদন্তি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও জাতীয় চার নেতাসহ জানা-অজানা শত সহ¯্র নেতা শত শত বছরের মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তি। বিজয়ের সরকারি তথা জাতীয় উদযাপনে এই সকল মহান নেতাদের মূল্যায়ন কতটুকু?
বর্তমানে দেশের জাতীয় ঐক্যখ- ছিন্ন। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না। পরমতসহিষ্ণুতা ও পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আমাদের জাতীয় লক্ষ্যও অস্পষ্ট রয়েছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। জাতীয় সংস্কৃতির প্রাণশক্তি আজ ক্ষয়িষ্ণু। জাতিসত্তার যে অমিত তেজ অসম্ভবের বিন্ধ্যাচল টলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল তা যেন চলৎশক্তিহীন, নিশ্চল। কেন এমন হলো? আমরা কেনো দিনকে দিন পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছি? পৃথিবীর বহু দেশ আজ আমাদের ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কেনো?
তবে, স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান যে উন্নত হয়েছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে জীবনযাত্রার প্রত্যাশিত মান অর্জন করা গেছে কি না এবং সর্বস্তরের মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে কি না-সেটাই দেখার বিষয়। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ কৃতিত্ব বর্তমান সরকার ও কৃষিবিজ্ঞানীদের। তবে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা আজও সম্ভব হয়নি। ভেজাল খাবার খেয়ে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যানসারসহ বিভিন্ন মরণব্যাধিতে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সরকারকে আরও বেশি যতœশীল হতে হবে।
দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা আরও করুণ। মান্ধাতা আমলের সিলেবাস দিয়ে চলছে পাঠদান। গবেষণা নেই, নেই কোনো সৃষ্টিশীলতা। স্বল্প গবেষণা হলেও অভিযোগ ওঠে নকলের। আবার চাকরির বাজারের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা পদ্ধতির কোনো মিল নেই। কর্মসংস্থান একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম ধারক ও বাহক। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার নিয়ে প্রায়ই ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। সরকারি তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। এর মধ্যে আবার ৪০ শতাংশ বেকার উচ্চশিক্ষিত। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। ক্রমেই বাড়ছে এ সংখ্যা।
সার্বিকভাবে দেশের উন্নতি হয়েছে। তবে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নে ঝুঁকে পড়ার ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই ঠিকই কিন্তু রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়েছে খুন, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি। দুর্নীতি দমন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে দেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে-তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিলাল হোসেন মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।