আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে উপকূলীয় এলাকার দুই হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ভাঙ্গনে অনেক বসত বাড়ির চিহ্নও নেই । আকাশে কাল মেঘ ও সাগরের নিম্নচাপ দেখলেই উপকূলবাসীর বুক ভয়ে কেঁপে উঠে। দেশের সাগর তীরবর্তী অর্থাৎ উপকূলীয় ২১টি জেলায় লাখ লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ উপকূলের যথাযথ সুরক্ষা নেই। উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ সর্বত্রই ভাঙাচোরা ক্ষতবিক্ষত। অনেক জায়গায় বাঁধের চিহ্নও নেই। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তছনছ উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ। এতে করে প্রতি বছর এসব এলাকার বসতভিটা, ফল-ফসলি জমি, ফাউন্দি ক্ষেত, খামার, লবণের মাঠ, চিংড়িসহ মাছের ঘের, মিঠাপানির উৎস পুকুর-কুয়া-নলকূপ, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে একাকার। হাজার হাজার একর জমি লবণাক্ত হয়ে চাষের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে। এসব এলাকায় উঁচু বাঁধ নির্মাণে পরিকল্পনা থাকলেও বাঁধ নির্মাণে নজর নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের। ভাঙা বাঁধ মেরামতে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও তাতে রক্ষা হয় না উপকূল। অথচ টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে সমুদ্রবন্দর, পোতাশ্রয়, বিমানবন্দর, শিল্প-কারখানা, প্রাকৃৃতিক ও খনিজ সম্পদসহ অপার সম্ভাবনা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
শুস্ক মৌসুমে যখন বেড়িবাঁধ মেরামত করার সুযোগ থাকে তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড তা মেরামত করে না। ফলে প্রাকৃৃতিক দুর্যোগের সময় অনেক স্থানেই বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কোথাও কোথাও ঠিকাদাররা দায়সারাভাবে বাঁধের মেরামত কাজ শেষ করে। ফলে দুর্যোগে সহজেই ওসব বাঁধ ভেঙ্গে যায়। দেশের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় মোট ১ হাজার ৯১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ২৪০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
ষাটের দশকে মাটি দিয়ে তৈরি ওই বেড়িবাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া। কিন্তু এখন ওই ২৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও চওড়ার অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই। অর্থাভাবে দীর্ঘদিনেও প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার করতে না পারায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ষাটের দশকে তৈরি ওই বেড়িবাঁধের বেশিরভাগই দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে বাঁধগুলো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং নিম্নচাপ, লঘুচাপ, আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে লোকালয়ে পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে এখনো অধীশতাধীক গ্রাম পানির নিচে। তাছাড়া নিম্নচাপ এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারেও বাঁধ উপচিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। ফলে উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি, খুলনার কয়রা, দাকোপ ,পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা; এবং বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলার কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সূত্র জানায়, দেশের উপকূলীয় তিন জেলার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও গভীরতা এবং সেগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাছাড়া ওই বাঁধ দীর্ঘদিনেও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। লবণাক্ত মাটি দিয়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো তৈরি। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নদীর পানিও লবণাক্ত। লবণাক্ত পানি বেড়িবাঁধের মাটির বন্ডিং দুর্বল করে ফেলে। অতিরিক্ত জোয়ারের পানির চাপে বাঁধের মাটি ধুয়ে যায়। তাছাড়া বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে চিংড়ি ঘেরে লবণপানি তোলার কারণেও বেড়িবাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। তাছাড়া উপকূলীয় নদীগুলোতে পলি পড়ে নাব্য কমে হেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে যে বেড়িবাঁধ রয়েছে তা দিয়ে উপকূলীয় জনপদ রক্ষা করা সম্ভব নয়। সেজন্য নতুন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
উপকূলের বাসিন্দারা জানান, দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়া নিম্নচাপ এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে বাঁধ উপচিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এর ফলে উপকূলীয় খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা; সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলার কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাগর পাড়ের বাঁধগুলো উঁচুকরণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে সংশ্লিষ্টদের খুব একটা গুরুত্ব ও নজর না থাকার কারণে জোয়ারে পানিতে প্রতি বছরই উপকূলীয় এলাকা ডুবে-ভাসে। গতবছর দীর্ঘস্থায়ী জোয়ারে সাগর পাড়ের লাখ লাখ মানুষ ছিল পানিবন্দি। বর্তমানে অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে উপকূলের অনেক এলাকা। দেশের দক্ষিণ-পূর্বে টেকনাফ-কুতুবদিয়া, বাঁশখালী-সন্দ্বীপ, লক্ষ্মীপুর থেকে দক্ষিণের দ্বীপজেলা ভোলা, বরিশাল, খুলনা হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাগেরহাট-সাতক্ষীরা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে বিস্তীর্ণ উপকূল-চর-দ্বীপাঞ্চলে শুধুই ভাঙন। এসব এলাকার কয়েক লাখ বাসিন্দা এবং সেখানকার জনবসতি, অবকাঠামো অরক্ষিত। অনিশ্চিত জীবন-জীবিকা। তাইতো উপকূলবাসী কাফনের কাপড় পরে ভাঙা বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে দাবি জানায় ‘ত্রাণ চাই না, টেকসই বেড়ি বাঁধ চাই’।
পাউবো খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সফি উদ্দিন জানান, উপকূলের অনেক স্থানেই বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৪/১নং পোল্ডার মেরামতসহ দুটি প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পেয়েছে। সেগুলোর নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। দুই-এক মাসের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হবে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কার ও পুনর্বাসনের কাজ আগে করা হবে। তাছাড়া ২০, ২১, ২২ ও ৩১নং পোল্ডারের বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …