স্টাফ রিপোটার, বরিশাল (ঝালকাঠী থেকে ফিরে) ॥ ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ ট্র্যাজেডির ঘটনাটি পরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন লঞ্চ মালিক হাম জালাল শেখ। তিনি বলেন, এতো দ্রুত তিনতলা পর্যন্ত আগুন ছড়ানো অবিশ্বাস্য। দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে ও সরকারকে বিব্রত করতে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আমি আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ইঞ্জিন রুমের আগুন ইঞ্জিন রুমেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং সেখানেই নেভানো যায়।
লঞ্চে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি ছিলোনা দাবি করে তিনি বলেন, লঞ্চে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ছিল। গত ১০ মাসে দুইবার এই লঞ্চে দুর্ঘটনা হয়। তবে সেসব ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়নি। তবে লঞ্চটির বিমা করা নেই বলে স্বীকার করেছেন লঞ্চ মালিক।
সবশেষ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহি চলন্ত এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাতে অগ্নিকাণ্ডের পর লঞ্চের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আজ শনিবার সকালে মোবাইল ফোনে লঞ্চ মালিক হাম জালাল শেখ সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চের ইঞ্জিনে আগুন লাগলে কখনও পুরো জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পরেনা। বিকট শব্দে লঞ্চের দোতলা থেকে আগুন ছড়িয়ে পরে ইঞ্জিন ও কেবিনের দিকে।
মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের বাসিন্দা ও ঢাকার গুলশান এলাকায় বসবাসরত লঞ্চ মালিক হাম জালাল শেখ বলেন, লঞ্চের সুপারভাইজার আনোয়ার হোসেন ঘটনারদিন রাত আনুমানিক তিনটার দিকে তাকে ফোন করে আগুনের কথা জানান। এর ১০ মিনিট আগে বিস্ফোরণটি ঘটেছে। আনোয়ারের খবরের বরাত দিয়ে হাম জালাল বলেন, প্রথমে লঞ্চের দোতলায় একটা বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়, সাথে সাথে কেবিন ও লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন লাগে। তারপর তৃতীয় তলার কেবিন ও নিচতলায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পরে।
তিনি বলেন, গত নবেম্বর মাসে ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে বরগুনা ফেরার পথে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় লঞ্চটির ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয়। তবে যাত্রীরা বেঁচে যান। এরপর নতুন ইঞ্জিন বসানো হয়েছিল। এর আগে গত আগস্ট মাসে ঝালকাঠির রাজাপুরের চরপালট গুচ্ছগ্রামের কাছে ডুবোচরে নয়দিন লঞ্চটি আটকা ছিলো। লঞ্চে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিলোনা, ত্রুটি থাকলে ডুবোচর থেকে লঞ্চটি নামাতে পারতাম না। মাত্র দুই মাস হলো জাপানি নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করেছি। লঞ্চ মালিকের দাবি, লঞ্চটিতে ২১টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিলো। তবে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পরায় সেগুলো ব্যবহার করা যায়নি। লঞ্চটির বিমা করা ছিলো না বলে স্বীকার করে হাম জালাল শেখ বলেন, আমার কেন, কারও কোনো লঞ্চের ইন্সুরেন্স নেই।
তবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও সংস্থার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোঃ কবির হোসেন বলেন, লঞ্চের বিমা বাধ্যতামূলক। তাহলে দুর্ঘটনার স্বীকার অভিযান-১০ নামের লঞ্চটি বিমা ছাড়া কীভাবে চলছিল সে প্রশ্নে তারা বলেন, বিমা ছিলো কি না সে বিষয়ে কাজগপত্র দেখে বলতে হবে। অপরদিকে সুগন্ধা নদীতে লঞ্চ ট্রাজেডিতে মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও অক্ষত অবস্থায় একটি পবিত্র কোরআন উদ্ধার করা হয়েছে।
শেবাচিমে চিকিৎসা দিচ্ছেন ঢাকার সাতজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক ॥ লঞ্চে আগুন লাগার ঘটনায় দগ্ধদের চিকিৎসা দিতে মেডিক্যাল টিমের সাত সদস্য ঢাকা থেকে বরিশালে এসে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেছেন। শনিবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ওই সাতজন চিকিৎসক রাতেই বরিশালে এসে পৌঁছে রোগীদের সেবা প্রদান কার্যক্রম শুরু করেছেন।
দ্বিতীয় দিনের মতো চলছে উদ্ধার অভিযান ॥ সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনার পরের দিন নিখোঁজদের সন্ধ্যানে শনিবার সকাল থেকে ফের উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক বেল্লাল উদ্দিন জানান, উদ্ধার অভিযান সারাদিন অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও জানান, লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনার তদন্তে প্রশাসনের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠণ করা হয়েছে। বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তিরত ৮১ জনের মধ্যে ১৯ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। সেইসাথে ১৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। বাকি ৪৬ জনের মধ্যে পাঁচজন শিশু, পাঁচজন অর্থোপেডিক, তিনজন আইসিইউ এবং ৩৩ জন সার্জারী ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
প্রিয়জনদের খুঁজতে সুগন্ধায় স্বজনরা ॥ লঞ্চে আগুনের ঘটনায় নিখোঁজদের খুঁজতে ডুবুরিদের পাশাপাশি ট্রলার নিয়ে নদীতে নেমেছেন স্বজনরা। প্রিয়জনকে জীবিত বা মৃত খুঁজে পেতে শনিবার সকাল আটটায় ঝালকাঠির মিনি পার্ক এলাকা থেকে ট্রলার নিয়ে তারা নদীতে নামেন। অনেকে নিখোঁজদের ছবি নিয়ে নদীর পাড়ে পাড়ে ঘুরছেন। তবে এ পর্যন্ত নতুন করে কারো সন্ধান মেলেনি।
ক্যানটিন নয়; আগুন ইঞ্জিন থেকে ॥ লঞ্চে আগুন ক্যানটিন থেকে নয়, ইঞ্জিনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান এমপি। শনিবার সকালে আগুনে পোড়া লঞ্চ পরিদর্শনের সময় তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে সংবাদগুলো আমরা দেখেছি, সেগুলো আমলে নিয়ে পর্যালোচনা করে এবং লঞ্চটি পরিদর্শন করে কাজ করছে তদন্ত কমিটি।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান উপ-পরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, লঞ্চের ছয়টি সিলিন্ডারের মধ্যে একটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নৌ-মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রধান যুগ্ম সচিব তোফায়েল হাসান বলেন, যা কিছু দেখছি, সবই প্রাথমিক তদন্ত। চূড়ান্তভাবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছেনা।’
তবে লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের পাশের ক্যানটিনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পুরো লঞ্চে আগুন লেগেছে বলে দাবি করে কেবিন বয় ইয়াসিন বলেন, লঞ্চের নিচ তলার পেছনে ইঞ্জিন রুমের পাশেই ক্যানটিন। সেখানে বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পরে ইঞ্জিনরুমে। সেখানে ১৩ ব্যারেল ডিজেল রাখা ছিল। ডিজেল আগুন আরও বাড়িয়ে দেয়।
ইঞ্জিনরুমের পর আগুন চলে যায় ডেকের দিকে। ডেকের জানালার পর্দা থেকে দোতলায়। সেখানে প্রথমে পারটেক্স বোর্ডের সিলিংয়ে আগুন লাগে। দোতলায় একটি চায়ের দোকান ছিল। ওই চায়ের দোকানের সিলিন্ডারও বিস্ফোরিত হয়ে আগুন আরও বড় হয়ে যায়। এরপর আগুন যায় তিন তলায়। লঞ্চের কেবিন বয় আরও জানান, আগুন লাগার পর ডেকের যাত্রীরা নেভানোর চেষ্টা করেন। অনেকে ছাদে চলে যান। কেউ কেউ নদীতে লাফিয়ে পরেন।
অবশেষে দগ্ধ সবাই শয্যা পেলেন ॥ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে আগুনে দগ্ধদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট বন্ধ থাকায় রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে সার্জারি ওয়ার্ডে। বেড ফাঁকা না থাকায় অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মেঝেতে। আবার অনেকের স্থান হয়েছিল সিঁড়িতে। দ্বগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার খোঁজ নিতে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে বরিশালে পৌঁছেই শেবাচিম হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে বিষয়টি নজরে পরে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি’র। তাৎক্ষনিক তিনি রোগীদের বেড দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে দ্বগ্ধ রোগীদের হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে স্থানান্তর করা হয়।
র্যাবের হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়েছে দুইজনকে ॥ সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় হতাহতদের মধ্যে দুইজন গুরুতর আহত রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য র্যাবের হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়েছে। র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ-আল মামুন এবং র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে শুক্রবার সন্ধ্যায় আহতদের মধ্যে গুরুত্বর দুই রোগীকে র্যাবের হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যেক পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেয়ার দাবি ॥ লঞ্চে আগুনের ঘটনায় দগ্ধ ও আহত যাত্রীদের রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসা ও মৃত প্রত্যেক যাত্রীর পরিবারকে যাত্রীসাধারণের অর্থে গঠিত নৌ-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
স্বজনদের আশ্রয় হয়েছে বিদ্যালয়ে ॥ সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিখোঁজদের সন্ধানে আসা স্বজনদের রাত্রীযাপনের জন্য ঝালকাঠি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আশ্রয় দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম পারভেজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লঞ্চের নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনদের মাঝে খাবার, পানি ও কম্বল বিতরণ করেছেন।
উল্লেখ্য, অভিযান-১০ লঞ্চটিতে কতোজন যাত্রী ছিল তার সঠিক তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। বিআইডব্লিউটিএ’র নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, লঞ্চটিতে প্রায় চারশ’ যাত্রী ছিল। তবে লঞ্চ থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের অনেকে বলছেন, নৌযানটিতে প্রায় আটশ’ যাত্রী ছিলো। বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে।