সাতক্ষীরায় নদী খননের নামে হরিলুট: দখলের মুখে ২৭টি নদী

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: নদীর বুকে বসত ঘর, বেড়িবাঁধ দিয়ে মৎস্যচাষ, ফারাক্কা বাঁধ, অপরিকল্পিত ব্রিজ স্লুইসগেট-বাঁধ নির্মাণসহ চর দখল করে নদী শোষনের ফলে উপকূলীয়া জেলা সাতক্ষীরায় ছোট-বড় ২৭টি নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এসব নদীতে জোয়ার ভাটা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে খুলনা ও যশোর এলাকার কয়েক নদী এরই মধ্যে মারা গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রথম এক দশক পর্যন্ত নদীগুলো প্রবহমান থাকলেও আশির দশক থেকে এর মরণদশা শুরু হয়। ফলে পানি নিষ্কাশনের অভাবে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্ট হচ্ছে । দুটি গবেষণার রির্পোটে বলছে দেশে গত ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২১ বছরে (২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও দখলের কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।
উত্তরণের পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতনা, শালিখা, শালিতা, হামকুড়া, চুনা ও হাতিটানার মতো তীব্র স্রোতের নদী এখন শুকিয়ে বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। মূলত অপরিকল্পিতভাবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ক্রমাগত নদ-নদী ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায়, তা বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ এর ফলে খাদ্য ঘাটতিও বেড়ে যাবে বহুল পরিমাণে এবং হুমকির মধ্যে পড়বে বিশ্বের জীববৈচিত্র্য৷
পলি জমা, উজানের সময় নদী তীরে জলের প্রত্যাহার, নির্বিচার দখল ইত্যাদির কারণে, আজ দেশের অসংখ্য নদীর অস্তিত্বই আশংকাজনক ৷ এছাড়া সুন্দরবন ও সাগর বিধৌত সুজলা-শ্যামলা সাতক্ষীরা জেলায় ২৭টি নদ-নদীর তীরে গড়ে উঠা শহর বন্দর ও জনপদে স্বেচ্ছাচারীভাবে নদীর তীরে এমনকি চর দখল করে নদীর মধ্যেও গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি, দোকানপাট, ইটভাটা, কৃষিখামার। পানি প্রবাহ হারিয়ে মুমূর্ষ দশায় নদীগুলোর এ দখলদারিত্ব নদীর অস্তিত্বকে আরেক দফা হারিয়ে দিয়েছে। ফলে জেলার ২/১ নদী বাদে অধিকাংশ নদীতে বন্ধ হয়ে গেছে জোয়ার-ভাটা। কপোতাক্ষ, বেতনা, কাকশিয়ালী, খোলপেটুয়া, কালিন্দি, মরিচ্চাপ, যমুনা, সোনাই, বলুয়া, গলঘেষিয়া, গুতিয়াখালি, সাপমারা নদীসহ ছোট-বড় ২৭ নদ-নদীর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এসব নদীতে এক সময় বড় বড় লঞ্চ, ষ্টিমার, গহনার নৌকা চলতো। সে সময় নদীগুলোতে প্রবল জোয়ার ও ¯্রােত থাকলেও এখন তা মরা খালের মতো নিশ্চল হয়ে আছে।
সূত্র মতে, সাতক্ষীরার নদ-নদীগুলোর মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় দখল দারিত্ব ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত স্লুইসগেট। এছাড়াও উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, অপরিকল্পিত স্লুইসগেট ছাড়াও এ অঞ্চলের নদীর ওপর ৪৮টি সেতু- নদী মৃত্যুর অন্যতম কারণ।সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগে ২১৬টি স্লুইস গেট রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এর মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। এ ছাড়া ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় ও অবৈধ দখল দারিত্বের কারণে পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বেতনা নদী তার নাব্য হারিয়ে পুরোপুরি একটি মৃত খালের রূপ নিয়েছে। অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে মরিচ্চাপের।এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ খনন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে আর আগের মতো জোয়ার-ভাটা হয় না। কোনোভাবে নদীটি মরা খালের মতো বেঁচে আছে। বেতনা নদীসহ মরিচ্চাপ ও যমুনা খনন করা হলেও দখল দারিত্বের কারণে তা র্পূর্বের অবস্থায় ফেরেনি। বেতনা নদী বা বেতনা-কোদালিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এই নদী ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৯১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৫৫ মিটার হলেও এখন নদীটি শুধুই স্মৃতি হতে চলেছে। নদীটিতে এখন পানি প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ।
এ দিকে নদী খননের পর পূর্বের চেয়ে আরো খারাপ হয়েছে বলে দাবী উঠেছে। ফলে নদ-নদী খননের নামে সরকারের নেয়া শত শত কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন প্রশ্নবৃদ্ধের মুখে পড়েছে। নদী খনন করে খাল আর খাল খনন করে নালা করার অভিযোগ উঠেছে। জনগণের পকেটের টাকা সরকার এভাবে নষ্ট করতে পারেনা বলে দাবী সংশ্লিষ্টদের। সাতক্ষীরা শহর ও পাশ্ববর্তী এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৩ দফা প্রস্তাবনা সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। দাবী গুলোর মধ্যে ইছামতি নদীর সাথে মরিচ্চাপ নদীর সংযোগ পুর্নস্থাপনে লাবন্যবতীর দু’মুখে স্থাপিত শাখরা-টিকেট এবং সাপমারার দু’মুখে স্থাপিত হাড়দ্দহা-কামালকাটি স্লুইসগেট অপসারণ অথবা দুই নদীর সরাসরি সংযোগ স্থাপনের জন্য স্লুইসগেটের পার্শ্ব দিয়ে বেড়িবাঁধ কেটে বিকল্প চ্যানেল তৈরী করতে হবে। ০২. সাতক্ষীরা শহরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়র খালের সাথে বেতনা নদীর পুর্নসংযোগ স্থাপনে খেজুরডাঙ্গী স্লুইসগেট এবং মরিচ্চাপ নদীর পুনঃসংযোগ স্থাপনে এল্লারচার স্লুইসগেট (বর্তমানে অস্তিত্বহীন) অপসারণ অথবা পার্শ্ব দিয়ে বেড়িবাঁধ কেটে বিকল্প চ্যানেল তৈরী করতে হবে। ০৩. কোলকাতার খাল এবং শ্রীরামপুর-বাকাল খালের দু’মুখের সকল বাঁধা অপসারণ করতে হবে। ০৪. ইছামতির পানি প্রবাহ পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পূর্বেই লাবন্যবতী, সাপমারা, মরিচ্চাপ, কোলকাতার খাল ও শ্রীরামপুর-বাঁকাল খালের বেড়িবাঁধ যেখানে প্রয়াজন সেখানে উঁচু ও মজবুত করতে হবে এবং বিলের পানি নিষ্কাশনের খালের মুখে থাকা স্লুইস গেটগুলো সংস্কার করতে হবে। ০৫. প্রকল্পভুক্ত সকল নদী-খালের সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সীমানা পিলার স্থাপন করতে হবে। নদী খালের ম্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ০৬. প্রকল্পভুক্ত নদী খাল খননের সকল মাটি নদী খালের সীমানার বাইরে অবক্ষেপণ করতে হবে। কোন আবস্থাতেই নদী-খালের মধ্যে ডাম্পিং করে নদী বা নদীর পাড় ভরাট করা যাবে না। ০৭. গ্রাম-শহরের বর্ষার পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখে মাছ চাষের জন্য পরিকল্পিতভাবে নিদিষ্ট জোন সৃষ্টি করতে হবে। ০৮. শালিখা নদীর সাথে বেতনা নদীর পুর্নসংযোগ স্থাপনসহ প্রকল্পের বাইরে থাকা অন্যান্য নদীগুলোর আন্তঃসংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ০৯. ইছামতি নদীর পানি প্রবাহ নিশ্চিত হওয়ার পর লাবন্যবতী, সাপমারা, কোলকাতার খাল, শ্রীরামপুর-বাঁকাল খাল, মরিচ্চাপ ও খোলপেটুয়া নদী খনন ছাড়াই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। ১০. ইছামতির পানিতে নদী-খালের সুবিধাজনক স্থানে টিআরএম চালু করতে হবে। ১১. নদী খাল খনন এলাকায় জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে। ১২. প্রকল্পের জন্য একটি টেকনিক্যাল এডভাইজারি গ্রুপ তৈরী করতে হবে। ১৩. ‘সকল নদী খালর ইজারা বাতিল’ এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।
আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ২৫/১২/২০২১

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।