আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা থেকে: অধ্যাপক একেএম ফজলুল হক একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি আন্দোলন, একটি সংগঠন, একটি বিষ্ময়কর প্রতিভা। যুগ নয়, শতাব্দীর ক্ষণজন্মা ইসলামী আন্দোলনের এক অগ্রসেনানী অধ্যাপক ফজলুল হক। নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের রক্তচক্ষু মোকাবিলা করে তৃণমুল থেকে গড়ে উঠে আসা একজন সংগ্রামী প্রাণ পুরুষ ফজলুল হক একটি কল্যান রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন আজীবন। সাতক্ষীরার মাটি, আলো-বাতাস এবং মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে আছে তার জীবন, তার সংগ্রাম। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা তাকে প্রেরণার বাতিঘর হিসেবেই দেখছেন। তার চিন্তা চেতনা,সাহসিকতা আর বলিষ্ঠতা এ অঞ্চলের ছাত্র যুব সমাজ তথা ইসলাম প্রিয় মানুষের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে। তার অমর কৃৃতির জন্য তিনি চির অমর হয়ে থাকবেন সবার মাঝে। মেধাবীদের সাহসী ঠিকানা শহীদী কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের মত একটি ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সংগঠক হিসেবে অবদান রেখেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন সে আন্দোলনের সিপাহসালারের। এত অল্প বয়সে ইসলামী আন্দোলনের ঘাটি হিসেবে পরিচিত সাতক্ষীরা জেলার সংগঠনে এনে ছিলেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাঁর মৃত্যুতে হাজারো মানুষ সমাগত হয়ে ছিল কলারোয়ার ফুটবল মাঠে। একপর্যায়ে উপুস্থিত ইসলাম প্রিয় মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে কলারোয়া ফুটবল মাঠের আকাশ বাতাশ। তিনি অমর হয়ে থাকবেন কোটি মানুষের হৃদয়ে।
ব্যক্তি জীবনে অল্পে তুষ্ট, নির্লোভ, পরোপকারী, দৃঢ়চেতা, সংগ্রামী জননেতা অধ্যাপক ফজলুল হক খুব অল্প সময়ে দক্ষিণ বাংলার এই জনপদের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। নিজের কর্ম তৎপরতায় সদা তৎপর তিনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার লড়াইয়ে তিনি অন্যতম। সভা-সেমিনারে তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা সেক্যুলার ও বামপন্থীদের ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে জিঘাংসা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শীতা অর্জনে খুব অল্প সময়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। অধ্যাপক ফজলুর রহমানের মেধা, যোগ্যতা, নেতৃত্বের গুণাবলী গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে যায় অল্পসময়ে। আজকের এই মুহূর্তে কোটি- কোটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর অশ্রুশিক্ত চোখে জায়নামাজ ভাসাচ্ছে এই প্রিয় মানুষটির জন্য।মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে ঢের সময় লেগে যায়। প্রকৃত আদর্শবান মানুষের পরিচয় এই ঘূর্ণায়মান মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেশ বিরল। এই প্রকৃত আদর্শবান মানুষেরা তাদের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন, হয়ে যান মানব সভ্যতার ইতিহাসের অমোচনীয় অংশ। অধ্যাপক ফজলুল হক প্রকৃতপক্ষে মানব সত্ত্বাবান অসংখ্য মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে গঠিত এই রকম একজন রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন। অধ্যাপক ফজলুল হক একটি নাম, একটি বিস্ময়কর প্রতিভা, একটি ইতিহাস, একজন কিংবদন্তী।
জন্ম ও বংশ পরিচয়: অধ্যাপক অধ্যাপক পজলুল হক ১৯৭৪ সালের ২৬শে মেপ্টেম্বর কলারোয়া উপজেলার ৮নং কেরালকাটা ইউনিয়নের (সোনাবাড়ি) বহুড়া গ্রামে একটি দ্বীনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামহ মাষ্টার আব্দুর রহিম ও মাতা শামসুর নাহার। ৬ ভাই বোনের মধ্যে ফজলুল হক ছিলেন তৃতীয় আর ভাইদের মধ্যে ছিল সবার বড়। ২০১৩ সালে তাঁর পিতা জামায়াতের প্রবীণ রোকন ইন্তিকাল করেন।
শিক্ষা জীবন: ১৯৮০ সালে স্থানীয় বলিয়ানপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার লেখাপড়ার জীবন শুরু হয়ে চলে ৮৫ পর্যন্ত।পঞ্চম শ্রেণীতে কৃতিত্বের সাথে তিনি উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৬ থেকে ৯১ ইং পর্যন্ত তিনি সোনাবাড়ি হাইস্কুলে অধ্যায়নরত ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি কলারোয়া সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে জেলার গন্ডি পেরিয়ে তিনি ১৯৯৩-৯৪ সেশনে খুলনা বিএল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এমএসএস পাশ করেন। লেখা পড়া মেষ করে ২০০৩ সালে তিনি সাতক্ষীরা সিটি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বিভাগীয় প্রধান অবস্থায় তিনি এহকলের জীবন শেষ হয়। রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন: ১৯৯১ সালে তিনি ছাত্র শিবিরের কর্মী এবং ১৯৯৩ সালে এইচএসসি পড়াকালিন তিনি ছাত্র সংগঠনের সাথীর শপথ গ্রহণ করেন। খুলনা বিএলকলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় ১৯৯৫ সালে তিনি ছাত্রশিবিরের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। পরে খুলনা মহানগর এলাকায় একটি শিশু কিশোর ছাত্র সংগঠনের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে খুলনা মহানগর অফিস সম্পাদক,২০০১ সালের মহানগর সেক্রেটারী এবং ২০০২ সালে খুলনা মহানগর সভাপতির দায়িত্ব থাকা কালিন তিনি ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরি সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করার সময় তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হন। এর পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত কলারোয়া উপজেলার সেক্রেটারী,পৌরসভার আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তি সময়ে তিনি সাতক্ষীরা জামায়াতের অফিস সম্পাদক এবং ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে থেকে চলতি সময় পর্যন্ত তিনি সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে তাকে অন্যায় ভাবে গ্রেফতার করা হয়। তাকে ১৭টি রাজনৈতিক মামলায় আসামী করা হয়। দীর্ঘ ৬ মাস করাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্ত হন। রাজনৈতিক মামলায় তাকে আর সাতক্ষীরা কোটে হাজিরা দিতে হবে না। তিনি গত ২৬ ডিসেম্বর আল্লাহর মেহমান হিসেবে চলে গেছেন। এত অল্প সময়ে এক জনের পক্ষে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্ব পূর্ণ দায়িত্ব পালন করার দৃষ্টান্ত তিনিই রেখে গেছেন।
মৃত্যুর আগে তিনি তার পরিবারকে বলে গেছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের মত এত বড় নেয়ামত দুনিয়াতে আর একটিও নেই। আমার জানামতে এই সংগঠন দুটি পৃথিবীর মধ্যে সেরা সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যপারে আমি সন্তুষ্ট। আমার জন্য দলটি যা করেছে তার ঋণ কোন দিন শোধ করতে পারবো না। তাই এই বাড়িটি সংগঠনকে দিয়ে দিও।
সাতক্ষীরা জামায়াতের আমীর মুহাদ্দীস রবিউল বাশার বলেছেন, তাঁর মত এক জন যোগ্য,দূরদৃষ্টি সম্পন্ন,বিচক্ষণ,যোগ্য সংগঠক পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে সাতক্ষীরা বাসীর অনেক আশা আঙ্কার প্রতিফন ঘটেছে। আল্লাহ তাঁকে সবোচ্চ জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমীন ।
https://youtu.be/hvUtwf5HdYY