রনজিৎ বর্মন, সুন্দরবনাঞ্চল (শ্যামনগর): নারী ও প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। নারীরা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। সভ্যতার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আদিম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত কৃষির যে উন্নয়ন তার সূচনা নারীর ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান দ্বারাই। গ্রামাঞ্চলে একজন নারীর জীবন সম্পূর্ণ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল।
গ্রামীণ নারীরা প্রকৃতি থেকে ফুল, ফল, বীজ, জ¦ালানী কাঠ, পশু খাদ্য চিকিৎসার জন্য লতাপাতা, বীজ সংগ্রহ করে থাকেন। মূলত নারীরা তার ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান দ্বারা চুড়ান্তভাবে টিকিয়ে রাখেন তার পরিবারকে এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়নের শংকরকাটি গ্রামের গীতা রানী মন্ডল। বয়স তার সাতচল্লিশ বছর। পরিবেশ সচেতন এই নারী কয়েক যুগ ধরে ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবারের পুষ্টির যোগান দিয়ে চলেছেন। পরিবেশ ও পরিবারের কোন রুপ ক্ষতিসাধন না করে গীতা রানী আপন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংরক্ষণ করেন তার পারিবারিক বন। সেখান থেকে সারা বছর মৌসুম ভিত্তিক রাসায়নিক সার কীটনাশক ছাড়াই সম্পূর্ণ জৈবিক পদ্ধতিতে সারা বছর তার পারিবারিক বনে বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি যেমন-আলু, বেগুন, বাধাকপি, সিম, টমেটো, ফুলকপি, ওলকপি, ঝালসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করে থাকেন। তিনি বাড়ির একটি নির্দিষ্ট স্থানে গর্ত করে তাতে উঠানের ময়লা আবর্জনা, তরকারির উচ্ছিষ্ট অংশ, হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা, গরুর গোবর জমা করেন। উক্ত সব কিছুর মিশ্রণে তৈরী করেন জৈব সার। এছাড়া বেসরকারী সংগঠন নকশীকাঁথার মাধ্যমে ভিসিও বাংলাদেশের অপশন প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে ভার্মি কম্পোষ্ট অর্থাৎ কেঁচো কম্পোষ্ট সার উৎপন্ন করে নিজ ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করেন এবং কেঁচো বিক্রী করে আর্থিকভাবে লাভবান হন।
গীতা রানীর এই সফলতার জন্য ২০১৬ সালে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে উৎসবমুখর পরিবেশে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা ’ অর্জন করেন। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে শ্যামনগর উপজেলার বেসরকারী নারী সংগঠন নকশীকাঁথার পক্ষ থেকে ভিএসও বাংলাদেশের সহায়তায় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ‘সাফল্য গাঁথা নারী ’ হিসাবে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। গীতা রানী মন্ডল একজন সফল সমবায়ী। তিনি শংকরকাটি মহিলা সমবায় সমিতির সভাপতি। এছাড়া তার এলাকার ১৬টি মহিলা সমবায় সমিতির গ্রুপ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এ সকল সমবায় সমিতিগুলি নারীরা পরিচালনা করে থাকেন। প্রথম পর্যায়ে ভিএসও বাংলাদেশ অপশন প্রকল্পের আওতায় নকশীকাঁথার মাধ্যমে এই সমিতিতে অফেরতযোগ্য একটি মোটা অংকের অর্থ প্রদান করে ভিত্তি স্থাপন করেন। মহিলা সমবায় সমিতি পরিচালনায় দক্ষতা অর্জন ও শ্রেষ্ঠ মহিলা সমবায়ী হওয়ায় ২০২১ সালে ৫০তম জাতীয় সমবায় দিবস ২০২১ উপলক্ষে শ্যামনগর উপজেলা সমবায় দপ্তরের পক্ষ থেকে শংকরকাটি মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেডকে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ সম্মাননা স্বারক প্রদান করা হয়। যে স্বারকটি গীতা রানী মন্ডল গ্রহণ করেন। তিনি বেসরকারী সংগঠন এসডিএফের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মহিলা সমবায় সমিতিরও গ্রুপ সভাপতি।
গীতা রানী বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত কৃষি ফসল পরিচর্যা, উৎপাদন, সার ব্যবস্থাপনা, রোগ বালাই দমন, জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে কোন কোন সময়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। উপজেলা কৃষি অফিসের প্রশিক্ষণেও তিনি ফ্যাসিলিটিটেড করে থাকেন। সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সফল কৃষি খামার থেকে জ্ঞান সংগ্রহের জন্য অভিজ্ঞতাবিনিময় সফরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। বর্তমানে তার সাথে উপজেলা কৃষি অফিসার, উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি অফিসারবৃন্দ যোগাযোগ রাখেন এবং তার মতামতের গুরুত্ব দেন।
কৃষি ফসল উৎপাদনে অভিজ্ঞতা অর্জন, কৃষিতে আগ্রহী হয়ে উঠার পিছনে তিনি নকশীকাঁথা মহিলা সংগঠনের কথা উচ্চারণ করেন। আর জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি ফসল উৎপাদনে প্রথম প্রতিযোগিতা শুরু তার স্বামী রনজিৎ মন্ডলের সাথে। নিজ ভিটায় পাশাপাশি সম প্লট আকারে স্বামী রনজিৎ মন্ডল রাসায়নিক পদ্ধতির মাধ্যমে ও গীতা রানী জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে একই সবজি উৎপাদন করেন। সমায়ান্তে দেখা যায় গীতা রানীর উৎপাদিত ফসলের পরিমান বেশি ও স্বাদে অতুলনীয়। সেই থেকে তার স্বামী গীতা রানীর সাথে পরামর্শ করে অদ্যবধী সকল প্রকার ফসল উৎপাদন করেন। মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসে দেখেন আর্থিক দুরবস্থার কারণে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হত না, এটা দেখে আয়ের বিকল্প হিসাবে টিউশনীর পাশাপাশি কৃষি কাজকে বেছে নেন। প্রথম দিকে স্বামীর সব মিলিয়ে জমি ছিল মাত্র ১৫ কাঠা। কৃষি ফসল উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে জমি ক্রয় করেছেন প্রায় দুই বিঘা। এ ছাড়া প্রতি বছর ১ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে কৃষি ফসল উৎপাদন করে তার লভ্যাংশ দিয়ে চিরঞ্জিত ও সম্বিত নামে দুই পুত্র সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। প্রায় প্রতিবছর বাড়ির এক একটি সম্পদ তৈরী করছেন। বর্তমান শীত মৌসুমে দৈনিক তিন থেকে চার হাজার টাকার শীতকালিন সবজি বিক্রী করছেন। উপজেলার বড় বড় বাজার নওয়াবেঁকী, শ্যামনগর সহ অন্যান্য স্থানে সবজি বিক্রয় করছেন।
২০১৪ সালে তার পরিচয় হয় নকশীকাঁথা মহিলা সংগঠনের নারী কর্মীর সাথে এর পর কৃষি ক্লিনিকে সাথে যুক্ত হয়ে জৈব প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন সংগঠনের অপশন প্রকল্পের মাধ্যমে এবং একই সাথে বিনা সুদে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে প্রথমবার বৃহত আকারে সবজি চাষ প্রকল্প শুরু করেন । এই টাকার উৎপাদিত সবজি থেকে ঋণ পরিশোধ করা ছাড়াও উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে জমি বর্গা নিয়ে অন্যান্য ফসল উৎপাদন করেন। গীতা রানীর এই সফলতার কারণে গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ তার উৎপাদিত ফসলের অনুকরণে ফসল ফলানোর চেষ্টা করেন বা উৎপাদন করছেন। গীতা রানী গ্রামীণ কৃষির একটি মডেল বলে স্থানীয় কৃষকবৃন্দ বা অন্যান্যরা মতামত পেশ করেন। গীতা রানীর স্বপ্ন ভবিষ্যতে দুই সন্তানকে সরকারিতে অন্তভুক্তিকরণ এবং বাঁকী জীবন পারিবারিক ভিটায় কৃষি নিয়ে জীবনযাপন ।