শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার চার কারণ

করোনায় নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। এর মধ্যেও সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য সোমবার সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ এখন যেভাবে চলছে, ঠিক সেভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলবে। মূলত চার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে রোববার রাতে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়। এরপরই সোমবার আসে এ ঘোষণা। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

কারণ চারটি হচ্ছে-সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনো বিপজ্জনক রূপ নেয়নি। চলতি মাসের মধ্যেই ৭৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার কাজ শেষ হবে। এছাড়া শিক্ষার ক্ষয়ক্ষতি আর না বাড়ানো এবং ইতোমধ্যে হয়ে যাওয়া ক্ষতি চিহ্নিত করে তা পূরণের কাজ এগিয়ে নেওয়া।

শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে কয়েকটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হবে। এগুলো মধ্যে আছে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং আগের মতোই সীমিত পরিসরে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হবে। পাশাপাশি বাড়ির কাজ, অ্যাসাইনমেন্ট এবং অনলাইন ও দূরশিক্ষণ (টিভি-বেতার) কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখলেও সার্বক্ষণিক করোনা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হবে। এছাড়া সাত দিন পর শিক্ষা বিভাগ ফের জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বসবে। পরিস্থিতির অবনতি হলে এবং অবস্থা বুঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত হতে পারে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাধারণ শিক্ষার্থীরা আগের মতো সবদিন স্কুল-কলেজে আসবে না। এছাড়া ক্যানসার ও ক্রনিক কিডনি রোগী এবং রিউম্যাটিক ও অ্যাজমা রোগীরও দৈনিক আসার প্রয়োজন নেই। তাদের বিষয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সদয়ভাবে বিবেচনা করবে।

সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। এ সময় তিনি প্রাসঙ্গিকক্রমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আগামী এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা, বই বিতরণ, নতুন শিক্ষাক্রম এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) শিক্ষক আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন। এ সময় তিনি জানান, ‘আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করছি না। আমরা আশা করছি, সবাই মিলে একসঙ্গে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে।’

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ দেশে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে মার্চে এই পরিস্থিতি আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে এটা ঠিক যে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রনে’ বিশ্বের অনেক দেশ এখন পর্যুদস্ত। এসব বাস্তবতায় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বৈঠকটি হয়েছে। কমিটি পরামর্শ এবং টিকাপ্রদান পরিস্থিতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা অনুসরণ করা হবে।

মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী ওই ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে-৩১ মার্চের মধ্যে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সি স্কুল-কলেজ সব শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া হবে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে নিশ্চিত করা হবে। কওমি মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানে করোনার বাস্তবতায় প্রণীত বিধিবিধান বাস্তবায়নে ঘাটতি আছে। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে কঠোর তদারকি করা হবে। ১২ বছর কম বয়সি বা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন নেই। তাই এই বয়সি শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে তাদের স্কুল আর শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ব্যবস্থা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছে। এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার কারণে জটিলতা হয়নি বলে তারা রোববার রাতের বৈঠকে জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, যারা টিকা দেয়নি তারা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে না। এ সময়ে অনলাইন আর টেলিভিশনে ক্লাস করবে। তাছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা আছে, ১২ জানুয়ারির পর থেকে টিকা ছাড়া কেউ স্কুলে যাবে না। সেটা প্রতিপালিত হবে।

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধাপে ধাপে খোলা শুরু হয়। এখনো সব প্রতিষ্ঠান খোলা শেষ হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই নতুন করে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। গত কয়েকদিনে লাফিয়ে বাড়ছে তা। ৩ জানুয়ারি সংক্রমণ ছিল পরীক্ষার হিসাবে ৩ শতাংশ। সোমবার এটি ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশে পৌঁছায়। অন্যদিকে ১২ সেপ্টেম্বর যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছিল, সেদিন সংক্রমণের হার ছিল ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে বলেন, যখন খুলে দিই, তখন ৭ শতাংশের কিছু বেশি ছিল সংক্রমণ হার। এখন অনেক ভালো পর্যায়ে আছে। তখন শিক্ষার্থীদের আমরা কোনো টিকা দিইনি। এখন ইতোমধ্যে প্রায় সব শিক্ষক টিকা নিয়েছেন। পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫১ শিক্ষার্থী আছে। তাদের মধ্যে ২৩ লাখ ২৮ হাজার ৪৬৮ জনের প্রথম ডোজ আর ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৩০২ জনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শেষ হয়েছে। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৭ লাখ ৩১ হাজার ২৮৭ জন টিকার জন্য নিবন্ধন করেছে। যারা নিবন্ধিত হয়নি আর টিকা দেয়নি, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক আছে।

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক প্রমুখ।

চার প্রমাণ দেখালেই টিকা: শিক্ষামন্ত্রী বলেন, টিকা প্রক্রিয়া একটু ধীরগতিতে এগোচ্ছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন কথা এসেছে। এখন সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ১২ বছরের ঊর্ধ্বে যে কোনো শিক্ষার্থী টিকাকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ছাত্রত্বের প্রমাণ উপস্থাপন করলেই টিকা পাবে। এক্ষেত্রে সে টিকার নিবন্ধন কার্ড দেখাতে পারে। নিবন্ধন করতে কিছু শর্ত মানতে হয়। এটি কারও পক্ষে সম্ভব না হলে আইডি কার্ড নিয়ে যেতে পারে। কারও আইডি কার্ড না থাকলে সে যদি শিক্ষককে নিয়ে যায় বা স্কুলের তালিকায় তার নাম থাকে তাহলেও টিকা দিতে পারবে। এছাড়া এবারের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যারা নিজ এলাকা ছেড়ে ভর্তির জন্য অন্যত্র গেছে, তারা পরীক্ষার প্রবেশপত্র দেখালেও টিকা পাবে। এজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

৩৫ শতাংশ টিকা পেয়েছে: শিক্ষামন্ত্রী জানান, দেশে ১২ বছরের ওপরে ১ কোটি ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৩২২ জন শিক্ষার্থী আছে। তাদের মধ্যে ৪৪ লাখ শিক্ষার্থী টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছে। সে হিসাবে ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ দিয়েছে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৪ জন। টিকার বাকি আছে ৭৫ লাখ ৫৪ হাজার ৬০৬ জন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী জানান, সব জেলায় সমানতালে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। কোথাও বেশি, আবার কোথাও কম দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি জেলায় ৯০ শতাংশের বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চার জেলায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ, ছয় জেলায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ, সাত জেলায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ, চার জেলায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ, চার জেলায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ, দশ জেলায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ, ১১ জেলায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, ১২ জেলায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে।

টিকা দেওয়ার রোডম্যাপ: সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী সব শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া শেষ করার রোডম্যাপও ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ৩৯৭ উপজেলায় ১৫ জানুয়ারির মধ্যে, ৩ উপজেলায় ১৭ জানুয়ারি, ৫৬ উপজেলায় ২০ জানুয়ারি, ১৫ উপজেলায় ২২ জানুয়ারি, ৩৫ উপজেলায় ২৫ জানুয়ারি এবং ১১ উপজেলায় ৩১ জানুয়ারির মধ্যে টিকাদান সম্পন্ন করতে হবে।

তিন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বৈঠক আজ : টিকায় সবচেয়ে এগিয়ে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টিকা পেয়েছে। সবচেয়ে পিছিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫১ জন। এর মধ্যে ১ম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে ২৩ লাখ ২৮ হাজার ৪৬৮ জনকে। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৩০২ জন। মোট নিবন্ধন করেছেন ২৭ লাখ ৩১ হাজার ২৮৭ জন।

অন্যান্য প্রসঙ্গ: সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কবে নেওয়া হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলার সময় এখনো আসেনি। আগে বলেছি, বছরের মাঝামাঝি এসব পরীক্ষা হবে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। সব বিষয়ে হবে না আংশিক, সেটা সময়মতো জানানো হবে। শিক্ষার্থীরা এখন ক্লাস করে যাবে।

তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে পাঠ্যবই ধাপে ধাপে বিতরণ করা হচ্ছে। না পৌঁছানোর কথা নয়। ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষাক্রম পাইলটিং হবে।

facebook sharing button
messenger sharing button
whatsapp sharing button

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।