আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরাসহ দেশের কয়েকটি জেলাতে বাণিজ্যিক ভাবে আম চাষে ঘটে গেছে এক বিস্ময়কর বিপ্লব। উৎপাদন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। তাই গাছে মুকুল আসার পূর্ব মুহূতে আম বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আম চাষিরা। আমের উৎপাদন বাড়াতে নানা মুখি পুরিচর্যায় সময় পার করছে তারা। একটাই উদ্দেশ্য আমের উৎপাদন বাঁড়েত হবে দ্বিগুণ। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৯৪তম দেশ বাংলাদেশ। তবে আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ ১০-এ। দেশেও ফলের রাজা আম। দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় এ ফলের। আর বছর বছর সেই উৎপাদন বাড়ছে। তাই দেশের মানুষের পুষ্টির অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে আম। শুধু পরিমাণের দিক থেকে আম বাংলাদেশের প্রধান ফল হয়েছে, তা নয়। সাতক্ষীরাসহ দেশের অন্তত ছয়টি জেলার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য হয়ে উঠেছে আম। বছর বছর নতুন নতুন আমবাগান হচ্ছে। তৈরি হয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। বাগান চাষ ও পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক ছাড়াও শুধু ফলনের মৌসুমেই অর্থাৎ বছরের প্রায় ৪/৫ মাস কয়েক হাজার মানুষ সারা দেশে আম সংক্রান্ত কর্মকান্ডে জড়িত থাকে।
সূত্রমতে আজ থেকে ১০ বছর আগে দেশে আমের উৎপাদন ছিল ১৩ লাখ টন। আর ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ লাখ টনে। আম উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মাথাপিছু বার্ষিক ভোগের পরিমাণ। স্বাদে, গন্ধে ও পুষ্টিগুণে আম অতুলনীয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টন। সারাদেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে বাণিজ্যিক ভাবে আম উৎপাদন হচ্ছে। অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে আমের উৎপাদন ২৪ লাখ টনের মতো। প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হয়। আম উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন, মোড়কীকরণ ও পরিবহন মিলিয়ে এ বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে।
দেশের ফল থেকে আসা পুষ্টি চাহিদার একটা বড় অংশের জোগান দেয় আম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে আমের চাষ বেড়েছে। বছরে ১৬ শতাংশ হারে ফলটির উৎপাদন বাড়ায় মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। আমের নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, সারা দেশে চাষ সম্প্রসারণ, কৃষকের অক্লালœ পরিশ্রম ও আধুনিক প্রযুক্ত ব্যহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে উঠে আসে । আগে সাতক্ষীরা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, মেহেরপুরের মতো কয়েকটি জেলাতেই আম চাষ সীমাবদ্ধ ছিল। আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ফলের রাজা আম এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থান করে নিয়েছে দেশের ৩০টি জেলায়।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি থেকে প্রাপ্ত জেলায় আমের বাগান রয়েছে ৫২৯৯টি। চাষীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১০০ জন। ২০১৫ সাল থেকে আম বিদেশে রপ্তানির জন্য চেষ্টা শুরু করে কৃষি বিভাগ। ২০১৬ সাল থেকে সাতক্ষীরার আম প্রথম ইতালীতে রপ্তানি শুরু হয়। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে প্রথম ২৩ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ওই বছরই কিছু আম রপ্তানি হয় ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে। রপ্তানি আয় হয় ১৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে রপ্তানি হয় ৩২ মেট্রিক টন। আয় হয় ২৪ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ২৯.৫ টন আম রপ্তানি করে আয় হয় ২১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে দশমিক ৬৯ টন আম ৪৮ হাজার টাকায় রপ্তানি করা হয়। ২০২০ সালে আম্পান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে কোন আম রপ্তানি হয়নি। এরপর ২০২১ সালে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ মেট্রিক টন।এবছর ২০২২ সালে আরো বেশি আম রপ্তানি করতে চাই জেলা কৃষি বিভাগ।
গত ২১ জানুয়ারী সাতক্ষীরার সুলতানপুর এলাকার কাজী মারুফ হাসানের ছেলে আম ব্যবসায়ী উজ্বালের সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন এবছর তিনি ২৪ বিঘা জমিতে ১৫শ টি আম গাছের বাগান পরিচর্যা করবেন। এতে তার জমির হ্যারিসহ ১৭ লাক্ষ টাকা মত খরচ হবে। আম ভাল হলে তার ২২-২৫ লাখ টাকার আম বেচা কেনা করতে পারবে। তার মত অসংখ্য ব্যবসায়ী এভাবে আমের বাগান পরিচর্যায় এখন ব্যস্ত সময় পার করছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরার মাটি ও পরিবেশ আমের জন্য অনেক সহায়ক। ফলে আমের চাষ জেলাটিতে দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবছর ও আমের উৎপাদন বাড়বে আশাবাদ কৃষিবিভাগের। আমা চাষিদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে জেলা কৃষি বিভাগ। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে সাতক্ষীলাতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে দাবী কৃষি একর্মকর্তার।
আম বাংলাদেশে দেশে মৌসুমি অর্থকরী ফল হিসেবে গুরুত্ব পেলেও একে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণের কার্যকর গবেষণা অদ্যাবধি নেয়া হয়নি। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে যেমন আমকে বিভিন্ন স্বাদে ভোগ করা যাচ্ছে না, ঠিক তেমনি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এই ফলের অনুকূল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। আমের জমির পরিমাণ ও উৎপাদনের মধ্যে তারতম্যের কারণ মূলত কার্যকর গবেষণার অভাব এবং জলবায়ু ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কুফল। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের অভিশপ্ত প্রভাব বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলে মরুকরণের যে প্রভাব ফেলেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও কম বেশি তার কৃপ্রভাবের শিকার।
জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে পুষ্টির অভাব মেটানো, কর্মসংস্থান তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজারজাতকরণ এবং গুদামজাত করে দীর্ঘমেয়াদি বিপণন প্রক্রিয়া গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক, অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানসহ শিল্পোউদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে আম শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ২১/১/২০২২