আমাদের সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আমেরিকা ও ইউরোপের মানবাধিকার এবং পুলিশি নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তারা এমন কথাও বলছেন, ‘সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আরো বেশি মানুষ নিহত হয়।’ তাদের এ দাবি অবশ্যই তথ্যভিত্তিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেদেশে যারা নিহত হন, তারা কি রাজনৈতিক মতপার্থক্য কিংবা ভিন্নমত প্রকাশের কারণে নিহত হন, নাকি ফৌজদারি অপরাধ করতে গিয়ে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তাদের কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গ্রেফতারের পর আদালতে হাজির না করে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নামে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মুখোমুখি করা হয়? আমেরিকার বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক মতপার্থক্য সেখানে সহিংস রূপ নিয়েছিল, সশস্ত্র ব্যক্তিরা ক্যাপিটাল হিলে গিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলি করেছে। তাদের গুলিতে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তারপরও হামলাকারীদের হত্যার উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছোড়েননি। অন্য একটি ঘটনায় সহিংস আন্দোলনকারীদের শান্ত করতে পুলিশ সদস্যরা হাঁটু গেড়ে বসে তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। তার মানে সেখানে রাজনৈতিক কারণে ভিন্নমত প্রকাশ করে সহিংস আচরণ করলেও পুলিশ ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করে। কারণ সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করে না।
কিন্তু আমাদের দেশে ভোটাধিকার না থাকলেও কারাগারগুলোয় এখন কোনো রাজবন্দী নেই, ভিন্নমত প্রকাশ করার কথিত অপরাধের মামলায় আটক সবাই ফৌজদারি মামলার আসামি। রাজনৈতিক দলের অধিকাংশ অফিস তালাবদ্ধ। বিশেষ করে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও মহানগরী অফিস খুলে যারাই বসতে চান, তাদের নাশকতার গায়েবি মামলার আসামি অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হয়। গায়েবি মামলার নথিতে নাম থাকার দরকার নেই, গং হাজার জনের একজন বিবেচনা করা হয়। জামিনে থাকলে নতুন নতুন মামলা সৃষ্টি করতে কালবিলম্ব হয় না। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের নেতারা সম্মানীত নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেনÑ এটাই রীতি। কিন্তু এদেশে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী মানেই অপরাধী, আসামি। যদিও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সত্তরোর্ধ্ব বয়সী মহিলা অধ্যাপক, কোনো জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদক কিংবা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সর্বোচ্চ পদে নেতৃত্বদানকারী কোনো সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা, তাতে কিছু এসে-যায় না। শাস্তি তাকে পেতেই হবে, যেহেতু তিনি ক্ষমতার পরিবর্তন চান, জনগণের ভোটাধিকারের কথা বলেন, মানবাধিকার রক্ষার দাবিতে সোচ্চার। এই যদি হয় দেশের অবস্থা, শুধু লবিস্ট নিয়োগ এবং গুম হওয়ার ব্যক্তিদের স্বজনদের চাপ দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিলেই কি মিত্ররা আমাদের বিশ্বাস করবেন? আমরা মনে করি, অবশ্যই তা করবেন না। ঐ যে আগেই বলেছি, তারা অন্য কারো কান দিয়ে কিংবা চোখ দিয়ে সত্য তালাশ করেন না।
তাই আমরা মনে করি, দেশ ও জাতির ওপর নিষেধাজ্ঞা নামের আরো বড় কোনো বিপদ আসার আগে সরকারের উচিত সকল রাজনৈতিক মামলা বাতিল, রাজনৈতিক দলের অফিসগুলো খুলে দিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। তা না হলে আগামী ২০২৩ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ অবাধ হবে না, ফলাফলে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না। ফলে আজকের এই সতর্ক সংকেত ভবিষ্যতে শাস্তি হিসেবে আসার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যাবে, যা আমাদের কারো কাম্য নয়।