পশ্চিমা অবরোধে আর্থিক ও খাদ্য সংকটে আফগানিস্তান

আফগানিস্তান এমন একটি মুসলিম দেশ, যাদের রয়েছে হাজার বছরের সংগ্রাম ও লড়াইয়ের ইতিহাস। তারা এক অপরাজেয় যোদ্ধা জাতি তথা লড়াকু জাতির দেশ। যারা শত শত বছর যুদ্ধ করে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, কিন্তু দেশের স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত হতে দেয়নি। ব্রিটিশরা পুরো ভারত উপমহাদেশকে দখল করেছিল, কিন্তু আফগানিস্তান দখল করতে পারেনি। সাম্প্রতিক ইতিহাসেও দেখা যায়, সোভিয়েত রাশিয়া মধ্য এশিয়ার ছয়টি মুসলিম রাষ্ট্র তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান ও আজারবাইজানকে দখল করতে পারলেও আফগানিস্তানকে দখল করতে পারেনি। সোভিয়েত রাশিয়া অবশ্য ১৯৭০-র দশকের শেষদিকে আফগানিস্তানকে দখল করে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আফগান মুজাহিদরা এক দশক ধরে যুদ্ধ করে আফগানিস্তানকে সোভিয়েত দখল থেকে মুক্ত করে। তারপর ১৯৯০ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এবারও আফগান মুজাহিদরা দুই দশক যুদ্ধ করে নিজ দেশকে উদ্ধার করে। বর্তমানে আফগানিস্তান স্বাধীন এবং আফগানিস্তানের জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের কাছেই তার শাসনভার। কিন্তু এবার তারা আর এক সংকটে পড়েছে। তা হচ্ছে আর্থিক ও খাদ্য সংকট। আর এ সংকট বিগত বছরের অপশাসন ও দখলদারিত্বের পাশাপাশি পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধের কারণেই সৃষ্ট হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, অস্ত্রে না পেরে আফগানদের ভাতে মারছে যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা অবরোধের কারণেই আফগানিস্তান আজ আর্থিক ও খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। আফগানিস্তানের এ সংকটময় মুহূর্তে ওআইসিসহ মুসলিম বিশ^কে এগিয়ে আসা উচিত।
বর্তমানে আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায়। তারা ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ইসলামী আমিরাত অব আফগানিস্তান। স্থলবেষ্টিত এ আফগানিস্তান দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী দেশ। এটি ইরান, পাকিস্তান, চীন, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, ও তুর্কমেনিস্তানের মধ্যস্থলে একটি ভূ-বেষ্টিত মালভূমির ওপর অবস্থিত। আফগানিস্তানের শতকরা ৪২ ভাগ হচ্ছে পশতুন আর ২৭ ভাগ হচ্ছে তাজিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। মোট জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় চার কোটি। এ চার কোটি জনগণের অধিকাংশই বর্তমানে খাদ্য সংকটের সম্মুখীন।
সর্বশেষ এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বর্তমানে আফগানিস্তানের প্রতি ৯টি পরিবারের মধ্যে আটটি পরিবারই খাদ্য সংকটের মধ্যে আছে। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই এ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। আর এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সারা বিশ^ থেকে তালেবান সরকারের বিচ্ছিন্নতার কারণে। এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, প্রায় দুই কোটি আফগানি, যা আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ ভাগ মারাত্মক খাদ্য সংকটের মধ্যে আছে।
বিশেষ করে শীতকাল শুরু হওয়ায় আফগানিদের খাদ্য সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ বামিয়ানের ৫৭ বছরের এক বিধবা নারী কুবরা বলছিলেন, কয়েক মাস আগে আমরা দুই বস্তা ময়দা সংগ্রহ করেছিলাম, সেগুলো প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এ শীতের মৌসুমে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও হিমশীতল বাতাসের কারণে কোনো কাজকর্ম করতে পারছি না। আগামী দিনগুলোয় কীভাবে খাদ্যের সংস্থান করব তা নিয়ে চিন্তায় আছি।
পাশর্^বর্তী প্রদেশের ২৬ বছর বয়সী মাসুমা নামে এক যুবতী মা বলছেন, আমরা সাধারণত দিনে একবার রান্না করতাম এবং তাতেই আমাদের খানার ব্যবস্থা হয়ে যেত, কিন্তু এখন সপ্তাহেও একবার রান্না করার কিছু পাই না এবং মাঝে মাঝে খাবার জন্য একটা রুটিও আমরা পাই না। কুবরা ও মাসুমার মতোই আফগানিস্তানের অধিকাংশ পরিবারের আর্থিক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
গত আগস্ট মাসে তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণের আগে পশ্চিমা সমর্থিত আফগান সরকারের অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল পশ্চিমাদের ওপর। কিন্তু তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তান নিয়ে সতর্ক অবস্থা নিয়ে দূরে আছে; অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবান অনেক নেতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
তালেবান নেতারা বলছেন, আমরা জনগণের এ আর্থিক দুর্দশার বিষয়টি অবহিত। তারা বলছেন, কয়েক দশকের বিরোধপূর্ণ যুদ্ধ ও বিগত সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণেই এ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে।
তালেবান নেতারা বার বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানের আটককৃত ৯০০ বিলিয়ন ডলার ফেরত দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ওয়াশিংটন আফগানিস্তানের ৯০০ বিলিয়ন ডলার অন্যায়ভাবে আটক করে রেখেছে।
তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, আমরা জনগণের দুঃখ-দুর্র্দশার বিষয়টি অবহিত এবং সংকট সমাধানের চেষ্টা করছি।
এমনি একটি পরিস্থিতিতে জাতিসংঘপ্রধান আফগানিস্তানের আর্থিক সংকট মোকাবিলায় আফগানিদের আটককৃত তহবিল ছেড়ে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ^ব্যাংক আফগানিস্তানের যে তহবিল আটক করেছে, তাতে করে আফগানিরা মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে। জাতিসংঘ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ^ব্যাংককে এ আটককৃত অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘ বলেছে, আফগানিস্তানের আর্থিক সংকট উত্তরণে ২০২২ সালে কমপক্ষে ৫০০ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দরকার হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, আফগানিস্তানের দরিদ্রতা, ক্ষুধা ও আফগানিদের অসহায়ত্ব দূর করতে হলে আর্থিক অবরোধ প্রত্যাহার করে দ্রুত অর্থের সরবরাহ বাড়াতে হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তানকে একটি মারাত্মক সংকট থেকে উত্তরণ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ বিশে^র অধিকাংশ ব্যবসা বাণিজ্যই চলে মার্কিন ডলারের মাধ্যমে।
এদিকে আফগানিস্তানের সংবাদ সংস্থা খামা প্রেস জানিয়েছে, আফগান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের কাছে অস্ত্রের লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে এখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজউদ্দিন হাক্কানির সঙ্গে দেখা করে দেশটিতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ওয়াং উই এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। গত ১৫ জানুয়ারি শনিবার চীনের রাষ্ট্রদূত ও আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক করেন।
চীনের রাষ্ট্রদূত আরও জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাকস্বাধীনতা, নারী ও মানবাধিকারকে আফগানদের মারার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে।
আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার ইজাম একটি ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, চীনের রাষ্ট্রদূত আফগানিস্তানকে সহায়তা করা, তাদের নিজস্ব ব্যাপারে মাথা না ঘামানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
ইঞ্জিনিয়ার ইজাম আরো জানান, ইসলামিক ভাবধারায় আফগানিস্তান সরকার গঠন করতেও সহায়তা করবে চীনÑ এমনটি জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত।
আফগানিস্তানের এমন একটি পরিস্থিতিতে কোনো বিদেশি সহায়তা ছাড়াই বাজেট দিয়েছে তালেবান সরকার। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর এটিই তাদের প্রথম বাজেট। গত ১২ জানুয়ারি বুধবার অনুমোদন দেয়া এই বাজেটে কোনো ধরনের বিদেশি সহায়তার উল্লেখ নেই। এএফপি।
তালেবান সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আহমদ ওয়ালি হকমল গত ১৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বলেছেন, আমরা বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরতামুক্ত একটি বাজেট তৈরি করেছি। গত দুই দশকে প্রথমবারের মতো এমন বাজেট ঘোষিত হলো। এটি আমাদের জন্য বড় অর্জন। মূলত ট্যাক্স, বাণিজ্য এবং খনির রাজস্বসহ নিজস্ব সংস্থান দ্বারা তালেবান কোষাগারের অর্থায়ন করা হয়।
আফগানিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসের জন্য দেয়া এই বাজেটের আকার ৫ হাজার ৩৯০ কোটি আফগান মুদ্রা। এর প্রায় পুরোটাই খরচ হবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নের জন্য। ৪৭০ কোটি আফগানি ব্যয় করা হবে পরিবহন অবকাঠামোসহ উন্নয়ন প্রকল্পে। হকমল বলেন, এ অর্থের পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু আমরা আপাতত এতটুকুই অর্থ বরাদ্দ করতে পারছি।
তিনি আরো জানান, সরকারি কর্মচারীদের অনেকে কয়েক মাস ধরে বেতন পাননি। তারা এ মাসের শেষ থেকে জানুয়ারির শেষে বেতন পেতে শুরু করবেন। যেসব নারী কর্মীদের কাজে যোগ দিতে আপাতত নিষেধ করা হয়েছিল, তাদেরও বেতন দেওয়া হবে। হকমল বলেন, নারী কর্মীদের বরখাস্ত করা হয়নি।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের পতনের মধ্য দিয়ে দেশটির ক্ষমতায় আসে তালেবান। এর পরের মাসে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেয় তারা। আগামী মার্চে তালেবান তাদের প্রথম বার্ষিক বাজেট ঘোষণা করতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ৪০ শতাংশ জিডিপিই আসে আন্তর্জাতিক সাহায্য থেকে। সাবেক মার্কিন-সমর্থিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালীন বাজেটের ৮০ শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সহায়তা। কিন্তু গত বছরের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর পশ্চিমা দেশগুলো বিলিয়ন ডলারের সাহায্য বন্ধ করে দেয়।
সূত্র : আল-জাজিরা, আনাদলু, টিআরটি ওয়াল্ড ও দ্য খামা প্রেস।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।